জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্য কি সর্বদা আল্লাহর রহমতের নিদর্শন?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: নাস্তিক বা অধার্মিক মানুষদের অনেককে দেখলে মনে হয়—কেন তারা দুনিয়ার সুখ-সমৃদ্ধিতে ডুবে থাকে? ঈমানদাররা তখন প্রশ্ন করেন, “যদি আল্লাহর আনুগত্যই প্রকৃত বরকত আনে, তবে অবাধ্য মানুষের জীবনে এই সব প্রাচুর্য কেন?” কোরআন ও আহলে বাইতের বাণী এই গভীর প্রশ্নের রূপবান উত্তর দেয়: সবসময়ের সমৃদ্ধি আল্লাহর রহমত নয়; বরং অনেক সময় তা হয় ইস্তিদরজ—ধীরে ধীরে পতনের পথ।

অনেকেই এমন মানুষদের দেখে বিস্মিত হন যারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ থেকে দূরে থেকেও দুনিয়ার আরাম, ধন-সম্পদ ও সমৃদ্ধির মধ্যে ডুবে থাকে। প্রশ্ন ওঠে তারা আল্লাহর নিয়ম মানে না, তবুও কেন এত সুখে? কোরআন ও প্রিয়তম নবী (সা.)-এর বাণী এই প্রশ্নের মৌলিক উত্তর দেয়।

আল্লাহ তাআলা কোরআনে এই ধরনের মানুষ সম্পর্কে বলেন—

﴿فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ فَتَحْنَا عَلَيْهِمْ أَبْوَابَ كُلِّ شَيْءٍ حَتّىٰ إِذَا فَرِحُوا بِمَا أُوتُوا أَخَذْنَاهُمْ بَغْتَةً فَإِذَا هُمْ مُبْلِسُونَ﴾

যখন তারা উপদেশ ভুলে গেল, তখন আমরা তাদের প্রতি সব দিক থেকে (দুনিয়ার) দরজা খুলে দিলাম; যতক্ষণ না তারা প্রাপ্তিতে আনন্দে মেতে উঠল। এরপর আমরা হঠাৎ তাদের পাকড়াও করলাম—আর তখনই তারা হতাশ ও স্তব্ধ হলো। —সূরা আন’আম, আয়াত ৪৪

ব্যাখ্যা:কিছু মানুষ দ্বীনদারদের উদ্দেশে বলে— যদি আল্লাহর আনুগত্যই বরকত আনে, তবে অধার্মিকরা এত সুখে কেন? কেন তাদের রিজিক বাড়তে থাকে, অথচ তাদের মধ্যে ঈমান বা তাকওয়া নেই?

উল্লিখিত আয়াত এই প্রশ্নের উত্তরের প্রথম দ্বার। এ আয়াত জানায়—যখন মানুষ আল্লাহর নির্দেশ ভুলে যায়, তখন আল্লাহ কখনো কখনো তাদের প্রতি দুনিয়ার সব দরজা খুলে দেন, যাতে তারা মনে করে সব ঠিক আছে। তারা যখন পুরোপুরি দুনিয়ার মোহে ডুবে যায়, তখনই আসে আকস্মিক শাস্তি—যার পর আর কোনো পথ খোলা থাকে না।

এ বিষয়ে একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—

«إِذَا رَأَيْتَ اللَّهَ يُعْطِي عَلَى الْمَعَاصِي فَإِنَّ ذَلِكَ اسْتِدْرَاجٌ مِنْهُ»

যদি দেখো আল্লাহ পাপীদের দুনিয়া দিচ্ছেন, জানবে—এটা আল্লাহর ইস্তিদরজ, অর্থাৎ ধীরে ধীরে তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। —তাফসির নূরুল-সাকালাইনে, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৭১৮।

কোরআন ও হাদিস একসঙ্গে স্পষ্ট করে দেয়—ইস্তিদরজ হচ্ছে আল্লাহর একটি সুন্নাত, যেখানে আল্লাহ পাপীকে কিছুদিন দুনিয়ার সুখ দেন, যাতে সে আরও অসতর্ক হয়ে পড়ে এবং শেষে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হয়। এই পরিস্থিতি মোটেও আল্লাহর দয়া নয়; বরং সতর্ক করার এক অদৃশ্য উপায়।

আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেন—

«يَا ابْنَ آدَمَ، إِذَا رَأَيْتَ رَبَّكَ يُتَابِعُ عَلَيْكَ نِعَمَهُ وَأَنْتَ تَعْصِيهِ، فَاحْذَرْهُ»

হে আদমসন্তান! তুমি যখন দেখো আল্লাহ পরপর তোমার প্রতি নিয়ামত বর্ষণ করছেন, অথচ তুমি তাঁর অবাধ্যতায় লিপ্ত—তখন সতর্ক হও; তাঁর কঠিন শাস্তি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারে। —নাহজুল বালাগা, হিকমাহ ২৫

উপসংহার

দুনিয়ার প্রাচুর্য, ধন-সম্পদ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য—সবসময়ই আল্লাহর রহমতের নিদর্শন নয়। অনেক সময় এগুলো ঈশ্বরীয় সতর্কবার্তা; এমন সমৃদ্ধি যা সত্যিকার বরকত নয়—বরং ধীরে ধীরে পতন ও দূরত্বের পথ। সুতরাং আল্লাহর সুন্নাহ সম্পর্কে সচেতনতা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়—যাতে সে বাহ্যিক আরাম নয়, বরং অন্তরের ঈমানের মূল্যকে বুঝতে পারে।

পাদটীকা

১. সুরা আন’আম, আয়াত ৪৪

২. তাফসির নূরুল-সাকালাইন, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৭১৮

৩. নাহজুল বালাগা, হিকমত ২৫

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button