ধর্ম ও বিশ্বাসজীবনযাপনবিশেষ সংবাদবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

ইমাম রেজা (আ.)-এর কৌশলগত পদক্ষেপে ‘ফাদাকের খুতবা’র অনুকরণ

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ঐতিহাসিক গবেষণা বলছে—ইমাম রেজা (আ.) তাঁর যুগে আব্বাসীয় শাসকদের সামনে যে যুক্তিনির্ভর সংগ্রাম চালান, তার কৌশলগত ভিত্তি ছিল হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) প্রদত্ত ফাদাকের খুতবা। উভয়েই কুরআনের মূল আয়াত এবং নবীজীর প্রামাণিক হাদিসকে যুক্তির ভিত্তি করে সত্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের সংগ্রামের লক্ষ্য একটাই—ইমামতের আল্লাহর প্রদত্ত নেতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা।

ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আব্বাসীয় শাসকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বিতর্কগুলোতে ইমাম রেজা (আ.) অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে ফাদাকের খুতবায় ব্যবহৃত হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) এর যুক্তিরীতি অনুসরণ করেছিলেন। উভয়েই কোরআন এবং হাদিসকে যুক্তির মূল ভিত্তি বানিয়ে, দখলদারদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন এবং ইমামতের ঐশী অবস্থান তুলে ধরেছেন।

ক) লক্ষ্য ও বক্তব্যের সাদৃশ্য

হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর সংগ্রাম কেবল ফাদাক নামক ভূমির পুনরুদ্ধারকে কেন্দ্র করে ছিল না; বরং তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল খিলাফতের প্রকৃত অধিকার উন্মোচন এবং ইমামতের সত্য প্রতিষ্ঠা। তিনি ইতিহাসের পাতায় এক সাহসী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ হয়েছিলেন।

অন্যদিকে, ইমাম রেজা (আ.) বাহ্যিকভাবে মামুনের যুবরাজত্ব তথা বেলায়াতে আহদী গ্রহণ করলেও, তাঁর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল ভিন্নতর। তিনি এই পদমর্যাদার আড়ালে আব্বাসীয় শাসনের অযৌক্তিকতা ও অপ্রকৃত নেতৃত্বের মুখোশ উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর নীরব প্রতিরোধ ছিল জ্ঞানের আলোয় আবদ্ধ, যা শাসকের ভ্রান্ত পথকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যুক্তি ও সত্যের মাধ্যমে।

খ) কোরআনের আয়াত দ্বারা যুক্তি

হযরত ফাতিমা (সা.আ.) ফাদাকের খুতবায়  আয়াতে তাতহির পাঠ করেন:

﴿إِنَّمَا یُرِیدُ اللَّهُ لِیُذْهِبَ عَنکُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَیْتِ وَیُطَهِّرَکُمْ تَطْهِیرًا﴾
(সূরা আল-আহযাব ৩৩)

তিনি স্পষ্ট করেন—আহলে বাইতের (আ.)ইমামত ও নেতৃত্বের যোগ্যতা আল্লাহ-প্রদত্ত এবং তাদের عصمة (নিষ্পাপত্ব) বিদ্যমান।

একই আয়াত ইমাম রেজা (আ.) বহু বিতর্কে উদ্ধৃত করে বলতেন:

«نحن أهل البیت الذین أذهب الله عنهم الرجس وطهرهم تطهیرا»

এভাবে তিনি যুক্তি দেন—ইমামতের শর্ত হল عصمة,নিষ্পাপত্ব এবং এর অধিকারী কেবল আহলে বাইত (আ.)।

গ) নবীজীর হাদিস দ্বারা যুক্তি

ফাদাকের খুতবায় হযরত ফাতিমা (সা.আ.) গদীরের প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেন, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) আলী (আ.)-কে উত্তরসূরি ঘোষণা করেছিলেন।

ইমাম রেজা (আ.) বিতর্কে হাদিসে সাকালাইন উদ্ধৃত করেন:

«إِنِّي تَارِكٌ فِيكُمْ الثَّقَلَيْنِ، كِتَابَ اللَّهِ وَعِتْرَتِي أَهْلَ بَيْتِي، وَإِنَّهُمَا لَنْ يَفْتَرِقَا حَتَّى يَرِدَا عَلَيَّ الْحَوْضَ»
(সহিহ তিরমিযি)

এই হাদিস স্পষ্ট করে—কোরআন ও আহলে বাইত (আ.) থেকে বিচ্ছিন্নতা মানে ভ্রান্তি।

ঘ) আহলে বাইতের ফজিলত ও মহিমা উল্লেখ

হযরত ফাতিমা (সা.আ.) আলী (আ.)-এর ত্যাগ, সাহস ও ফজিলত উল্লেখ করে তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা প্রমাণ করেন।

ইমাম রেজা (আ.) حدیث سلسلة الذهب  হাদীস সিলসিলাতুয্‌ যাহাব বর্ণনা করেন:

«كَلِمَةُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ حِصْنِي، فَمَنْ دَخَلَ حِصْنِي أَمِنَ مِنْ عَذَابِي»
তারপর বলেন:
«بِشُرُوطِهَا، وَأَنَا مِنْ شُرُوطِهَا»

অর্থাৎ—ইসলামের সত্য গ্রহণের শর্তগুলোর একটি হলো ইমামত।”

ঙ) দখলদারদের মুখোশ উন্মোচন

হযরত ফাতিমা (সা.আ.) ফাদাকের খুতবায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন—নবীজী (সা.)-এর স্পষ্ট নির্দেশকে উপেক্ষা করে কিছু লোক ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর কণ্ঠে ছিল সত্যের দীপ্তি, আর তাঁর বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছিল ন্যায়ের দাবিতে এক সাহসী প্রতিবাদ। ফাদাক ছিল শুধু একটি ভূমি নয়, বরং ছিল ইমামতের অধিকার ও নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক।

অন্যদিকে, ইমাম রেজা (আ.) রাজনৈতিক বাস্তবতার জটিল আবহে সরাসরি সমালোচনার পথ না বেছে নিয়েও, তাঁর কৌশল ছিল অসাধারণ প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ। ঈদের নামাজ পড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি এমন শর্ত আরোপ করেন, যা মামুনের পক্ষে মানা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই সূক্ষ্ম কৌশলের মাধ্যমে তিনি শাসকের দ্বিচারিতা ও ভ্রান্ত নেতৃত্বকে জনসমক্ষে উন্মোচিত করেন—নীরব অথচ গভীর এক প্রতিবাদের ভাষায়।

 উপসংহার

ইমাম রেজা (আ.) যুক্তি, প্রমাণ ও চরিত্র—এই তিন অস্ত্রে সেই পথ অনুসরণ করেন, যা শুরু করেছিলেন হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.):

১. লক্ষ্য: ইমামতের সত্য প্রতিষ্ঠা

২. পদ্ধতি: কুরআন + নবীজীর হাদিস

৩. ফলাফল: দখলদারদের মুখোশ উন্মোচন

এ এক ধারাবাহিক সংগ্রাম—সত্য নেতৃত্বের রক্ষায় আধ্যাত্মিক প্রতিরোধ।

ব্যবহৃত গ্রন্থসমূহ

১.কুরআন মাজিদ

.বিহারুল আনওয়ার, আল্লামা মাজলিসি

৩.উইউনু আখবারুর রেজা, শাইখ সাদূক

৪.সহিহ তিরমিযি (হাদিসে সাকালাইন)

৫.ইহতিজাজ, তাবরসি

৬.আলামুল ওরা, তাবরসি

৭.মুসনাদুল ইমাম রেজা, আজিজুল্লাহ আত্তারদি

আরও পড়ুন

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button