জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্বস্বাস্থ্য পরামর্শ

কেন মদের নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে কার্যকর করা হয়েছিল?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৮ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামে মদের নিষেধাজ্ঞা কোনো দৈব বিধানের পরিবর্তন ছিল না; বরং এটি ছিল এক গভীর সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সংস্কারের জন্য নেওয়া প্রজ্ঞাময়, ধাপে ধাপে অগ্রসরমান পদক্ষেপ। যে সমাজে মদ্যপান ছিল এক প্রাচীন ও প্রোথিত অভ্যাস, সেখানে এই সংস্কার ছিল সময়ের দাবি।

কুরআন ও ইতিহাসের আলোকে দেখা যায়— ইসলাম মদ্যপানের মতো গভীর সামাজিক অভ্যাসের বিরুদ্ধে হঠাৎ কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি; বরং জ্ঞানের আলো জ্বেলে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে, ধীরে ধীরে সমাজকে প্রস্তুত করেছে। এই প্রজ্ঞাময় ধাপগুলো শেষ পর্যন্ত এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যেখানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঐশী বিধানকে গ্রহণ করে নেয়— এবং নবুওতের যুগে এটি হয়ে ওঠে অন্যতম গভীর সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

মদের নিষেধাজ্ঞা সব ঐশী ধর্মেই এক স্থায়ী বিধান; ইসলামের ইতিহাসেও কখনো এমন সময় আসেনি যখন মদ বৈধ ছিল। তবে ইসলামে এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছিল ধীরে ধীরে— কোনো বিধান পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং এমন এক সমাজকে মানসিক ও নৈতিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য, যেখানে মদ্যপান ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

ইসলাম-পূর্ব আরবে মদ্যপান ছিল সংস্কৃতি, সামাজিকতা, অর্থনীতি ও উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি ছিল না কেবল একটি অভ্যাস; বরং কবিতা, বাণিজ্য, আতিথেয়তা ও গোষ্ঠীগত সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এমন প্রবণতা শুধু আরবেই নয়, বহু জাতি ও সভ্যতায়ও প্রচলিত ছিল।

এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ মদ নিষিদ্ধ করলে সমাজে প্রবল মানসিক প্রতিরোধ দেখা দিত। তাই কুরআন বেছে নিয়েছিল এক শিক্ষণমূলক ও ধীরগতির পদ্ধতি— যাতে মানুষের মনন ও আচরণ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। আল্লামা তাবাতাবায়ীর ভাষায়, এটি ছিল “সংস্কৃতির কোমল রূপান্তর”, যাতে সমাজ কোনো মানসিক ধাক্কা ছাড়াই তার ভুল ঐতিহাসিক অভ্যাস থেকে মুক্ত হতে পারে।

মদের নিষেধাজ্ঞার চার ধাপ

ইসলাম সমাজকে মদ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত করার জন্য যে পথ নিয়েছিল, তা ছিল ধাপে ধাপে অগ্রসরমান ও আত্মপ্রণোদিত এক প্রক্রিয়া— যার লক্ষ্য ছিল অন্তর্দৃষ্টির জাগরণ ও স্বেচ্ছা পরিত্যাগ।

১. প্রথম ধাপ: অশুদ্ধতার ইঙ্গিত

কুরআনের প্রথম উল্লেখে মদকে রাখা হয় “পবিত্র জীবিকা”-র বিপরীতে—

وَ مِنْ ثَمَرٰاتِ النَّخِیلِ وَ الْأَعْنٰابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَ رِزْقًا حَسَنًا
খেজুর ও আঙুরের ফল থেকে তোমরা প্রস্তুত কর মদ ও উত্তম জীবিকা।” (সুরা আন-নাহল, ১৬:৬৭)

এখানে মদকে ‘উত্তম রিজিক’-এর বিপরীতে স্থাপন করে সূক্ষ্মভাবে তার অমঙ্গলচিহ্ন তুলে ধরা হয়।

২. দ্বিতীয় ধাপ: আচরণগত সীমাবদ্ধতা

এরপর কুরআন মদ্যপ অবস্থায় নামাজে উপস্থিত হওয়া নিষিদ্ধ করে—

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَ أَنْتُمْ سُكَارَى
হে মুমিনগণ, তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাজের কাছেও যেও না।” (সুরা আন-নিসা, ৪:৪৩)

এটি ছিল বাস্তব জীবনে সংযম শেখানোর প্রাথমিক ধাপ, যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিত্যাগের অনুশীলন শুরু হয়।

৩. তৃতীয় ধাপ: জ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা

মানুষ যখন মদের বিষয়ে প্রশ্ন করল, কুরআন যুক্তিনির্ভর উত্তর দিল—

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَ الْمَيْسِرِ ۖ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَ إِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا
তারা তোমাকে মদ ও জুয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। বল, এতে আছে বড় পাপ এবং মানুষের জন্য কিছু উপকারও আছে; কিন্তু তাদের পাপ উপকারের চেয়ে অধিক।” (সুরা আল-বাকারা, ২:২১৯)

এভাবে কুরআন যুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে— যদিও মদের কিছু সাময়িক লাভ আছে, তার ক্ষতি ও পাপ তারচেয়ে বহু গুণ বেশি। এটি ছিল চিন্তার পুনর্গঠন, যেন মানুষ নিজের ভেতর থেকেই এর অসারতা বুঝতে পারে।

৪. চতুর্থ ধাপ: চূড়ান্ত ও স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা

যখন সমাজ মানসিক ও নৈতিকভাবে প্রস্তুত হলো, তখন কুরআন দৃঢ়তম ভাষায় ঘোষণা করল—

إِنَّمَا الْخَمْرُ وَ الْمَيْسِرُ وَ الْأَنْصَابُ وَ الْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَ الْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَ الْمَيْسِرِ وَ يَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَ عَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ
নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা ও ভাগ্যনির্ধারণের তীর— এ সবই অপবিত্র, শয়তানের কাজ; তাই এগুলো থেকে বিরত থাকো, যাতে তোমরা সফল হও। শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টি করতে এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?” (সুরা আল-মায়িদা, ৫:৯০–৯১)

কুরআনের অন্য কোনো বিধান এত শক্ত ও তীব্র ভাষায় ঘোষণা করা হয়নি। এখানে মদকে বলা হয়েছে “অপবিত্রতা” ও “শয়তানের কাজ।”
ফলস্বরূপ, এই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা নৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবে, আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর মুসলমানরা নিজেরাই তাদের মদ রাস্তায় ঢেলে দেয়। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয় কোনো জবরদস্তি ছাড়াই— মানুষের চেতনার ভেতরেই।

মদের নিষেধাজ্ঞার ধীরে বাস্তবায়নের নৈতিক ও সামাজিক প্রজ্ঞা

১. মদ্যপানের গভীর-প্রোথিত ঐতিহ্য

আরব সমাজে মদ্যপান ছিল শতাব্দীব্যাপী প্রচলিত এক প্রথা। এমন দীর্ঘকালীন অভ্যাস হঠাৎ পরিত্যাগ করা সম্ভব ছিল না—বরং তা জনসাধারণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ধর্ম থেকে বিমুখতার আশঙ্কা সৃষ্টি করত। তাই ইসলাম বেছে নেয়েছিল প্রজ্ঞাময় ও ধীরগতি সম্পন্ন একটি সংস্কারপদ্ধতি।

২. দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে তোলার পর কঠিন বিধান

মানুষের অন্তরে ঈমান যখন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কঠিন বিধান আরোপ করা সহজ হয়ে ওঠে। ধর্মীয় পণ্ডিতদের ভাষায়, এটি প্রমাণ করে যে ঐশী বিধানগুলো ধাপে ধাপে আরোপ করার মধ্যে রয়েছে গভীর প্রজ্ঞা—প্রথমে বিশ্বাস, পরে দায়িত্ব।

৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত রোধ

সে সময় মদ ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্যপণ্য; অনেকের জীবিকা ও সামাজিক সম্পর্ক এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে অর্থনীতি ও গোষ্ঠীগত ভারসাম্য ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ছিল। তাই ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন আনা হয়, যেন সমাজে কোনো ধাক্কা না লাগে।

৪. বাস্তব বাধ্যবাধকতার আগে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

প্রথমে জ্ঞান ও যুক্তির মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা হলো, এরপর আচরণের সীমাবদ্ধতা আরোপ, এবং শেষে এল স্পষ্ট ও চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা। এই ধাপবিন্যাস মানুষকে স্বেচ্ছায় পরিবর্তনের পথে নিয়ে গেল, জোর করে নয়।

৫. স্বেচ্ছায় পরিত্যাগের অনুপ্রেরণা

এই ধীর প্রক্রিয়াটি এমনভাবে গঠিত ছিল যে, মানুষ নিজের বিশ্বাস থেকেই মদ পরিত্যাগ করল—রাষ্ট্রীয় জোরজবরদস্তি ছাড়াই। এটি ইসলামী শিক্ষার অন্যতম সৌন্দর্য: হৃদয়ের পরিবর্তনই আসল রূপান্তর।

হাদীসে মদের নিষেধাজ্ঞা

হাদীসসমূহে মদকে বলা হয়েছে “সমস্ত পাপের জননী” (أُمُّ الخَبَائِث)।
রাসূলুল্লাহ ﷺ মদের সঙ্গে সম্পর্কিত দশ শ্রেণির মানুষকে অভিশাপ দিয়েছেন—

যারা মদের উদ্দেশ্যে আঙুর ফলায়, যিনি তা তৈরি করে, পরিবহন করে, বিক্রি করে, ক্রয় করে, পান করে, কিংবা তার বিক্রির অর্থ ভোগ করে— সকলেই এই অভিশাপের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম রেজা (আ.)-এর বাণীতে এসেছে—

«مَا بَعَثَ اللَّهُ نَبِيّاً قَطُّ إِلَّا بِتَحْرِيمِ الْخَمْرِ»
আল্লাহ কখনো কোনো নবীকে প্রেরণ করেননি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে মদের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ, মদ নিষিদ্ধকরণ সকল নবীর ধর্মেই এক অভিন্ন ও চিরস্থায়ী বিধান।

পাদটীকা

১. সুরা আন-নাহল (১৬:৬৭)
২. সুরা আন-নিসা (৪:৪৩)
৩. সৈয়্যেদ মোহাম্মদ বাকের মুসাভি হামেদানি, তাফসির আল-মিজান (বাংলা অনুবাদ), খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৯৪।
৪. সুরা আল-বাকারা (২:২১৯)
৫. সুরা আল-মায়িদা (৫:৯১)
৬. তাফসির আল-মিজান (বাংলা অনুবাদ), একই, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৯৮–২৯৯।
৭. শাইখ সাদূক, আত-তাওহিদ, জামে’আতুল মুদাররিসিন, কুম, ১৩৯৮ হিজরি, অধ্যায় ৫৪ “আল-বদা’”, পৃষ্ঠা ৩৩৪।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button