ইতিহাসবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

কেন ট্রাম্পের পশ্চিম এশিয়ার শান্তি পরিকল্পনা হাস্যকর?

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ডোনাল্ড ট্রাম্প সাম্প্রতিক বক্তৃতায় বারবার দাবি করেছেন যে তিনি পশ্চিম এশিয়াকে যুদ্ধ ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত করবেন এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু এই দাবি, কেবল মার্কিন বিদেশনীতিতে পরিবর্তনের নিদর্শন নয়; এটি মার্কিন চেহারা পুনর্গঠনের এবং নতুনভাবে অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা। প্রকৃতপক্ষে, ট্রাম্প যে শান্তি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তা ন্যায়বিচার বা ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপনের জন্য নয়, বরং মার্কিন ইচ্ছা অঞ্চলবাসীর ওপর চাপানোর একটি উপায়।

হস্তক্ষেপমূলক নীতি ও যুদ্ধের উত্তরাধিকার

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতি সীমাবদ্ধতা থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপ ও সামরিক কার্যক্রমের দিকে সরে যায়। ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ শিরোনামে তারা অঞ্চলটি ব্যাপকভাবে দখল করে।

  • আফগানিস্তান অভিযান (২০০১) এবং ইরাক অভিযান (২০০৩) ছিল সেই নীতির মূল স্তম্ভ।

  • এই অভিযানগুলো আড়ম্বরপূর্ণভাবে সন্ত্রাস রোধ ও গণতন্ত্র সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে করা হলেও, বাস্তবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, সামাজিক কাঠামো বিনষ্ট এবং ক্ষমতার শূন্যস্থান তৈরি হয়, যা উগ্রপন্থার বৃদ্ধি ঘটায়।

আল-কায়েদা ও দায়েশের (আইএস) মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ঠিক সেই শূন্যস্থান থেকে উদ্ভূত হয় যা মার্কিন হস্তক্ষেপ তৈরি করেছিল। ইরাকে, পল ব্রেমার কর্তৃক সামরিক ও সরকারি কাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হলে লাখ লাখ পুরাতন সেনা ও কর্মী ক্ষমতার চক্র থেকে বাদ পড়ে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দেয়। আফগানিস্তানে দুই দশকের সামরিক উপস্থিতির পরও মার্কিন বাহিনী কোনো নির্দিষ্ট অর্জন ছাড়াই চলে যায় এবং তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে।

এই দুঃখজনক অভিজ্ঞতা দেখায়, যুক্তরাষ্ট্র কেবল অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে, শান্তি বা স্থায়ী স্থিতিশীলতা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে দীর্ঘমেয়াদী সামরিক উপস্থিতি অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা দুর্বল করার বাইরে কিছু করেনি।

ইসরায়েল সমর্থন ও সহিংসতার বিস্তার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল সমর্থনও সহিংসতার বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছে। মার্কিন অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সহায়তা ইসরায়েলকে শক্তিশালী করেছে, ফলে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর অত্যাচার অব্যাহত আছে। সাম্প্রতিক দুই বছরে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং হাজার হাজার মার্কিন বোমা গাজায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এবং বারবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ভেটো করেছে। ফলাফল— পশ্চিম এশিয়া আরও গভীর সহিংসতা, অবিশ্বাস ও ধ্বংসের মধ্যে পড়েছে।

ট্রাম্পের শান্তি ছদ্মবেশ

এখন ট্রাম্প “মহা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি” নিয়ে আসেন। কিন্তু তার বক্তব্য ও আচরণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটি মূলত পূর্বের হস্তক্ষেপমূলক নীতির একটি নতুন, কূটনৈতিক মুখোশ। তিনি অঞ্চলীয় সংকটকে ব্যবহার করে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান পুনর্গঠন করতে চান।

ট্রাম্প প্রকৃতপক্ষে সামরিক প্রভাব কমাতে চান না; বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মাধ্যমে মার্কিন প্রভাবকে ‘কঠিন’ থেকে ‘নরম’ রূপান্তরিত করতে চান। অর্থাৎ, তিনি শান্তির আড়ালে আগের হস্তক্ষেপ পুনর্নির্মাণ করছেন। এটি তার প্রথম প্রেসিডেন্সিতে “আব্রাহাম চুক্তি”র মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই দেখা গেছে, যা কৃত্রিমভাবে কিছু আরব রাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি স্থাপন করেছিল, তবে ফিলিস্তিনের সমস্যা সমাধান হয়নি।

ন্যায়বিচারহীন শান্তি

ট্রাম্পের শান্তি হলো ন্যায়বিচারহীন শান্তি। তিনি আরব রাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চান, অথচ ফিলিস্তিন এখনও অবরুদ্ধ। গাজা ধ্বংসের মুখে। কখনও কখনও তার ইসরায়েল বিরোধী বক্তব্য ফিলিস্তিনের জন্য নয়, বরং মার্কিন কৌশলগত স্বার্থের জন্য। ট্রাম্প নিজেকে ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসেবে প্রেজেন্ট করে উভয় পক্ষ থেকে সুবিধা অর্জন করতে চান—আরবদের কাছ থেকে শান্তি, ইসরায়েলের কাছ থেকে নিরাপত্তা।

শান্তি কেবল জনগণের অধিকার

প্রকৃত শান্তি তখনই সম্ভব যখন অঞ্চলবাসী নিজ সিদ্ধান্ত নেবে, বিদেশি হস্তক্ষেপ ছাড়া। যতক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি বজায় রাখে, পশ্চিম এশিয়া মুক্তি পাবে না। ট্রাম্প কেবল নতুন অভিনেতা, যা আগের একই নাট্যসচিত্রে যুক্ত হয়েছে—এখানে যুক্তরাষ্ট্র আগুনও ধরায়, আর ধমক দিয়ে নিজ স্বার্থ নিশ্চিত করে।

ট্রাম্পের পশ্চিম এশিয়ার শান্তি পরিকল্পনা মূলত হাস্যকর ও স্বার্থপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ যা সবচেয়ে বড় অস্ত্র রপ্তানিকর্তা, ৮০-এর বেশি দেশে সামরিক ঘাঁটি রাখে, এবং প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার যুদ্ধ খরচে ব্যয় করে। প্রকৃত শান্তি তখনই সম্ভব, যখন সত্যিকারের ন্যায়, জনগণের অধিকার ও অঞ্চলের দেশগুলোর সহযোগিতা দ্বারা স্থাপিত হয়, না যে বাইরের শক্তি দ্বারা চাপানো হয়।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button