জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

অন্যকে লজ্জিত কোরো না, তাহলে তুমিও লজ্জিত হবে না

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: অপরের ত্রুটি প্রকাশ করা সহজ, কিন্তু নিজের ত্রুটি আড়াল করতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের স্বভাব। অথচ যিনি প্রকৃত “বন্দা”, তিনি নিজের মধ্যে তার প্রভুর রং ধারণ করেন—যেমন আল্লাহ নিজে ত্রুটিগুলো জানেন, তবুও সেগুলো প্রকাশ করেন না।
তাহলে একজন সত্যিকারের আল্লাহর বান্দা কীভাবে অন্যের লজ্জা ফাঁস করে দিতে পারে?

আল্লাহ তাআলা সবকিছু জানেন—তিনি মানুষের অন্দর ও বাহির উভয়েই অবগত। তবুও তিনি ستّارُ العُیوب — “ত্রুটি আড়ালকারী। মানুষ যতই পাপ করুক, তিনি সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত করেন না; বরং পর্দা টেনে রাখেন, যেন সে ফিরে আসতে পারে।

اَللَّهُمَّ لَکَ الْحَمْدُ عَلَی سِتْرِکَ بَعْدَ عِلْمِکَ

অর্থ: হে আল্লাহ! প্রশংসা তোমারই প্রাপ্য— তুমি আমাদের পাপ জানো, তবুও তুমি তা আড়াল করো।

ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এই দোয়ায় এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি শেখান, যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে—
আল্লাহ জানেন, কিন্তু অপমান করেন না; আর বান্দা যেন জানলেও লজ্জিত না করে।

প্রভুর রং ধারণ করা: আবদ” বা “বন্দা” হওয়ার মানে শুধু উপাসনা নয়, বরং প্রভুর গুণে গুণান্বিত হওয়া। যখন যিশু (আঃ)-এর শিষ্যরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল: আমরা কাদের সঙ্গে সঙ্গ দিব? তিনি বলেছিলেন: «مَنْ يُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ رُؤْيَتُهُ»

অর্থ:যার দিকে তাকালে তোমাদের মনে আল্লাহর কথা জাগে।

অর্থাৎ, যে মানুষ আল্লাহর রঙে রঞ্জিত—তার মধ্যে দেখা যায় দয়া, গোপনীয়তা ও পর্দা-পোশী স্বভাব। তাই প্রকৃত আল্লাহভক্ত কখনও অন্যের ত্রুটি প্রকাশ করে না; বরং চেষ্টা করে সেই ভাইকে লজ্জাহীনভাবে সংশোধন করতে।

অপরের ত্রুটি আড়াল করার মর্যাদা: ইমাম সাদিক (আঃ) বলেছেন—

«مَنْ سَتَرَ عَوْرَةَ مُؤْمِنٍ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ هَتَكَ سِتْرَ مُؤْمِنٍ هَتَكَ اللهُ سِتْرَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.»

যে কেউ একজন মুমিনের ত্রুটি আড়াল করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিনে তার ত্রুটি আড়াল করবেন। আর যে কেউ একজন মুমিনকে লজ্জিত করে, আল্লাহও কিয়ামতের দিন তাকে লজ্জিত করবেন।

এই বাণীতে স্পষ্ট হয়ে যায় —আল্লাহ আমাদের সঙ্গে ঠিক তেমন আচরণ করেন, যেমন আমরা অন্যদের সঙ্গে করি। যেমন আমরা কারও পর্দা রাখি, তিনিও আমাদের পর্দা রাখবেন।

 নিজেকে দেখা, অন্যকে নয়: ইমাম আলী (আঃ) বলেন: «مَنْ أَبْصَرَ عَيْبَ نَفْسِهِ شُغِلَ عَنْ عَيْبِ غَيْرِهِ.»

অর্থ:যে নিজের ত্রুটি দেখেছে, সে আর অন্যের ত্রুটি নিয়ে ব্যস্ত হয় না।”

অর্থাৎ, আত্মসমালোচনা হলো পরিপূর্ণতার প্রথম ধাপ। যে নিজের আত্মাকে চিনতে শুরু করে, সে অন্যের দোষগুণ বিচার করার সময়ই পায় না।

গোপনে উপদেশ দেওয়ার সৌন্দর্য:তবে “অপরের ত্রুটি আড়াল করা” মানে এই নয় যে, ভুল দেখেও চুপ থাকা। বরং আল্লাহর বান্দা অন্যের ভুলে বেদনাহত হয়, কিন্তু প্রকাশ্যে অপমান না করে—ভালোবাসার সঙ্গে, গোপনে তাকে সংশোধনের আহ্বান জানায়।

ইমাম সাদিক (আঃ)-এর বাণীতে এরই মর্মার্থ: «أَحَبُّ إِخْوَانِي إِلَيَّ مَنْ أَهْدَى إِلَيَّ عُيُوبِي.»

অর্থ:আমার কাছে সে-ই সবচেয়ে প্রিয় ভাই, যে আমার ত্রুটিগুলো উপহার হিসেবে আমাকে জানায়। অর্থাৎ, প্রকৃত ভাই সেই যে গোপনে, ভালোবাসায় ত্রুটি জানায়—লজ্জা নয়, জাগরণ ঘটায়।

মানুষ যতই জ্ঞানী হোক, সে ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু আল্লাহর নিকট যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ,সে হলো যে অন্যকে লজ্জিত করে না, বরং লজ্জা থেকে রক্ষা করে। তাই রাসুল (সা.)-এর এই আহ্বান যেন আমাদের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হয়— যেমন আচরণ তুমি চাও আল্লাহ তোমার সঙ্গে করুন, তেমন আচরণ করো তাঁর বান্দাদের সঙ্গে।

পাদটীকা:

১. সাহিফায়ে সাজ্জাদিয়া, দোয়া নং ৩৪।
২. উসূলুল কাফি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৯।
৩. মুস্তাদরাকুল ওয়াসায়েল, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ১০৯।
৪. তুহাফুল উকুল, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮৮।
৫. উসূলুল কাফি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৩৯।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button