জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদস্বাস্থ্য পরামর্শ

পারিবারিক সচেতনতা | কীভাবে রাগ-ধমক বা শাস্তি ছাড়াই শিশুর জেদী আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবেন?

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহিরশিশুর জেদ বা অবাধ্যতা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিবারের পরিবেশ ও সম্পর্ক। ঘর যেন শান্ত, ভালোবাসা ও সম্মানে পূর্ণ হয়; বাবা-মায়ের সম্পর্ক যেন সুস্থ, স্থিতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল হয়; আর শিশুকে ছোটখাটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। অতিরিক্ত কঠোরতা, বকাঝকা বা চিৎকার কখনো ইতিবাচক ফল দেয় না। কারণ সন্তান লালন আসলে বাগান পরিচর্যার মতো এক সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া—এটি কোনো নিয়ন্ত্রণ বা জোরজবরদস্তির খেলা নয়।

প্রশ্ন: আমার সাত বছর বয়সী ছেলে অত্যন্ত জেদী ও অবাধ্য। প্রায় সবকিছুতেই—পোশাক পরা, খাওয়া, ঘুমানো—সে আমার কথার ঠিক উল্টোটা করে। না শাস্তি, না বকাঝকা কোনোটি কাজ করছে; এমনকি পুরস্কার বা উৎসাহও তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয় না। এখন মনে হচ্ছে পুরো পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, আমি প্রায়ই চিৎকার করে ফেলি। এখন কী করব? কোনো কার্যকর ও বৈজ্ঞানিক উপায় আছে কি?

 

পরিবার ও বিবাহ পরামর্শ বিশেষজ্ঞ হুজ্জতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন রেজা ইউসুফজাদে “ভালোবাসার মাধ্যমে শিশুর জেদ নিয়ন্ত্রণ” বিষয়ে এক প্রশ্নোত্তর আলোচনায় বলেন—

এই সমস্যাটিকে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা প্রয়োজন—

১️. পারিবারিক পরিবেশ ও সম্পর্কের দিক থেকে,
২️. এবং মায়ের ব্যক্তিগত গুণাবলি ও মানসিকতার দিক থেকে।

প্রথম দিক: পারিবারিক পরিবেশ ও সম্পর্ক

ইসলামী বাণীতে এসেছে: الولد الصالح ریحانة من ریاحین الجنة অর্থাৎ, “সৎ ও উত্তম সন্তান জান্নাতের ফুলের মতো।”

এই উপমাটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর অর্থ বহন করে। যেমন ফুলের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয় ভালো মাটি, পর্যাপ্ত পানি ও যথাযথ আলো—
তেমনি সন্তানও তেমন এক পরিবেশেই সঠিকভাবে বিকশিত হয়।

  • ভালো মাটি হলো বাবা-মায়ের সম্পর্ক। যদি দাম্পত্য সম্পর্ক উত্তেজনা, মানসিক চাপ বা রূঢ় আচরণে ভরা হয়, তাহলে সেই ঘর হয়ে ওঠে এক অনুর্বর মাটি—যেখানে কোনো সুস্থ ফুল ফুটতে পারে না! ঘরকে তুলনা করা যায় একটি অ্যাকুয়ারিয়ামের সঙ্গে। যদি পানির তাপমাত্রা খুব ঠান্ডা বা খুব গরম হয়, প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছোট মাছগুলো। শিশুরাও তেমনি—অস্থির বা দ্বন্দ্বপূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে সবচেয়ে আগে মানসিক আঘাত পায়।

তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন— সন্তান লালনের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, পিতা-মাতার সম্পর্কের উন্নতি।”

যদি বাবা-মায়ের সম্পর্ক শীতল, বিবাদপূর্ণ বা টানাপোড়েনে ভরা হয়, তার সরাসরি প্রতিফলন দেখা যাবে সন্তানের আচরণে।

কোনো ফুল শূন্য বা নোনাজলে ফোটে না; তেমনি কোনো শিশু ঝগড়া, রাগ ও মানসিক চাপে ভরা ঘরে শান্ত ও স্থির হতে পারে না।

হাদিসে আরও বলা হয়েছে— “সন্তানের অধিকারগুলোর একটি হলো, পিতা যেন তার মাকে সম্মান করে ও তাকে আনন্দিত রাখে; এবং মাকেও পিতার প্রতি একই রকম আচরণ করতে হবে।”

লক্ষ করুন—এখানে সন্তানের অধিকার হিসেবে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ পিতা-মাতার সম্পর্কের প্রতিটি তরঙ্গ সরাসরি শিশুর মনোজগতে পৌঁছে যায়।

যদি বাবা-মা ঝগড়া করেন, সন্তানের কাছে সেটি যেন তার ছোট্ট পৃথিবীতে এক “বিশ্বযুদ্ধের” সমান। এর ফল হয় জেদ, অবাধ্যতা, ভয় ও মানসিক অস্থিরতা।

দ্বিতীয় দিক: মায়ের ব্যক্তিত্ব ও আচরণ

অনেক সময় বাবা-মা মনে করেন সন্তান তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা তাকে অতিরিক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। তবে সন্তানের লালন কোনো কুমারের কাজ নয়— যেখানে নিজের ইচ্ছেমতো মাটির পাত্র গড়া যায়। বরং এটি একজন মালী বা উদ্যানপালকের কাজ, যিনি ফুল ফোটার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেন।

তিনটি মূল উপাদান:

১. পর্যাপ্ত পানি: অর্থাৎ সন্তানের প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা।

২. যথাযথ আলো: অর্থাৎ সীমার মধ্যে স্বাধীনতা দেওয়া—শিশুকে সিদ্ধান্ত নেওয়া, অভিজ্ঞতা অর্জন ও ভুল করার সুযোগ দেওয়া।

৩. ভালো মাটি: অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক দাম্পত্য সম্পর্ক।

যদি এই তিনটি উপাদান সঠিকভাবে মিলে যায়, শিশু স্বাভাবিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ দেখাবে। অন্যদিকে, অতিরিক্ত কঠোরতা বা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করলে, সে প্রতিরোধ ও জেদের মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে।

সরল ও কার্যকর করণীয়

তাই বাস্তবিক সমাধান হলো— চিৎকার, রাগ বা অতিরিক্ত শাসনের পরিবর্তে মনোযোগ দিন নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে:

  • ঘরটিকে যতটা সম্ভব শান্ত ও ভালোবাসায় ভরা পরিবেশে রূপান্তরিত করুন।
  • আপনার সঙ্গীর (স্বামী/স্ত্রী) সঙ্গে সম্পর্ককে আরও মমতাময়, শ্রদ্ধাশীল ও সহযোগিতামূলক করে তুলুন।
  • শিশুকে ছোটখাটো বিষয়ে—যেমন কোন পোশাক পরবে, কোন খেলনাটি খেলবে, কখন পড়বে—এমন সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের সুযোগ দিন।

এই পরিবেশ তৈরি হলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর জেদ, রাগ বা অবাধ্যতার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।

শেষ কথা: আপনি সন্তানকে গড়তে নয়, তার বেড়ে ওঠাকে সাহায্য করতে এসেছেন।”যেমন মালী ফুলকে জোর করে ফুটাতে পারে না, বরং তার যত্ন নেয়— তেমনি ভালোবাসা, সম্মান ও শান্তিতে ভরা ঘরই শিশুর মানসিক বিকাশের সর্বোত্তম মাটি।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button