ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে নারীর অবস্থা ও ধর্মীয় বিশ্বাস: এক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিশ্লেষণ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইতিহাসের পাতায় ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে নারীর জীবন ছিল অবমাননা, বঞ্চনা ও অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন। সেই অন্ধকার যুগে নারী ছিল এক অবহেলিত অস্তিত্ব, যার মর্যাদা নির্ধারিত হতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী। ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে নারীরা ছিল সম্পূর্ণভাবে অধিকারহীন। তারা পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পেত না, বিবাহবিচারের অধিকার তাদের ছিল না, এবং পুরুষদের জন্য অসীম সংখ্যক বিবাহ বৈধ ছিল। কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, আর মেয়ের জন্মকে সমাজে লজ্জা ও কলঙ্ক হিসেবে দেখা হতো। নারীর অস্তিত্ব নির্ভর করত পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ইচ্ছার ওপর। এমনকি অবৈধ সম্পর্ক থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানদের নিয়েও সমাজে বিবাদ দেখা দিত।
তবে কিছু অভিজাত পরিবারে ব্যতিক্রম দেখা যেত, যেখানে মেয়েদের বিবাহে মতামতের স্বাধীনতা দেওয়া হতো। এই প্রথা পারস্যের উচ্চবিত্ত সমাজের অনুকরণে গড়ে উঠেছিল এবং আরব সমাজে শ্রেণিবৈষম্যের প্রতিফলন ছিল। সামগ্রিকভাবে, আরবদের নারীর প্রতি আচরণ ছিল এক মিশ্র সংস্কৃতি—একদিকে সভ্য জাতির মতো, অন্যদিকে বর্বর জাতির মতো। শাসন, যুদ্ধ ও বিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারীদের অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল পারস্য ও রোমানদের প্রভাব থেকে, আর কন্যাশিশুদের হত্যা ও নির্যাতনের মতো নিষ্ঠুরতা এসেছিল বর্বর জাতিগোষ্ঠী থেকে।
এই বঞ্চনার পেছনে কোনো ধর্মীয় পবিত্রতা বা পরিবারের প্রধানের পূজা ছিল না; বরং এটি ছিল শক্তিশালীদের দ্বারা দুর্বলদের শোষণের নগ্ন প্রকাশ।
আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রতিমাপূজার রূপ
আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল বিচিত্র ও অদ্ভুত। তারা পুরুষ ও নারী উভয়েই বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমা পূজা করত। তাদের বিশ্বাস ছিল অনেকটা সাবিয়ী সম্প্রদায়ের মতো, যারা নক্ষত্র ও প্রকৃতির শক্তিকে পূজা করত। তারা ফেরেশতা ও নক্ষত্রদের—যাদের তারা আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করত—চিত্র কল্পনা করে পাথর বা কাঠ দিয়ে মূর্তি তৈরি করত।
এই বিশ্বাস এতটাই বিকৃত ছিল যে, বনি হানিফা গোত্র খেজুর, দই, তেল ও আটা দিয়ে একটি প্রতিমা তৈরি করে বহু বছর পূজা করেছিল। কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময় তারা সেই প্রতিমাকেই খেয়ে ফেলেছিল!
এক কবি ব্যঙ্গ করে বলেন: হানিফা তাদের প্রভুকে খেয়ে ফেলল/ দুর্ভিক্ষের দিনে/ তারা ভয় পায়নি প্রভুর প্রতিশোধ/ না চিন্তা করেছে তার পরিণতি!
তারা কখনও একটি পাথরকে পূজা করত, কিন্তু যখন আরও সুন্দর পাথর পেত, আগেরটি ফেলে দিয়ে নতুনটিকে দেবতা বানাত। এমনকি কিছু না পেলে, মাটি জড়ো করে গাভীর দুধ দিয়ে তাতে মাটি মিশিয়ে মূর্তি বানাত এবং সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশে তাওয়াফ করত!
নারীর মানসিক অবস্থা ও কুসংস্কারের জন্ম
এই সমাজে নারীরা যে বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হতো, তা তাদের মনে গভীর দুর্বলতা সৃষ্টি করত। এই মানসিক দুর্বলতা থেকে জন্ম নিত নানা ধরনের কুসংস্কার ও অদ্ভুত বিশ্বাস, যা ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে সংরক্ষিত আছে।
এই ছিল ইসলাম-পূর্ব যুগে এবং ইসলাম আবির্ভাবের সময় নারীর সামাজিক অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র—একটি অন্ধকার অধ্যায়, যার পর ইসলাম নারীর মর্যাদা ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সূচনা করে।
সূত্র: তাফসির আল-মিজান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৪ ।



