বিশ্ববাংলাদেশবিশেষ সংবাদ

বাংলাদেশি চিন্তাবিদদের সতর্ক ধ্বনি : ইরানের পতনে মুসলিম বিশ্বের অস্তিত্ব কি টলে যাবে?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: বাংলাদেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম ও মুসলেমিন ড. সাইয়্যেদ মাহদী আলীজাদেহ মুসাভী, সম্প্রতি হওজা নিউজের সফরে এক আলোচনায় অংশ নেন। সেখানে তিনি মিডিয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন:

আজকের বিশ্বে সেই ব্যক্তি সফল, যে অন্যদের আগে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারে এবং তা নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়।

উপমহাদেশ: মুসলিম বিশ্বের জনসংখ্যা ও চিন্তার কেন্দ্র

তিনি আরও বলেন, উপমহাদেশ শুধু জনসংখ্যার দিক থেকেই নয়, বরং চিন্তাশীলতা ও ইসলামি জ্ঞানের দিক থেকেও মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানকার বহু মনীষী ইসলামি চিন্তা ও ফিকহে গভীর প্রভাব রেখেছেন।

বিশ্ব রাজনীতিতে উপমহাদেশের প্রতি অবহেলা

বাংলাদেশে ইরানের প্রতিনিধি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, উপমহাদেশের গুরুত্ব সত্ত্বেও, বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণে এই অঞ্চলকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ এই অঞ্চলের মানুষ বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে ইরানের পাশে থেকেছে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের জনগণ ও সরকার ইরানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছে।

সতর্কতা ও আহ্বান

তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি এই অঞ্চলের প্রতি যথাযথ মনোযোগ না দেওয়া হয়, তবে মুসলিম জনসংখ্যার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে পারে এবং তাদের সমর্থন হারিয়ে যেতে পারে। তাই ইরানসহ মুসলিম বিশ্বের উচিত, উপমহাদেশকে তাদের নীতিমালায় আরও গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা।

ইরানের মর্যাদার উত্থান: মুসলিম বিশ্বের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু

হুজ্জাতুল ইসলাম ও মুসলেমিন ড. সাইয়্যেদ মাহদী আলীজাদেহ মুসাভী, যিনি বাংলাদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দপ্তরের প্রতিনিধি, সম্প্রতি আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবে সফর শেষে জানান— আজ ইরান মুসলিম বিশ্বের শক্তি ও প্রতিরোধের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, এই দেশগুলোর জনগণ ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইরানের প্রতি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

আঞ্চলিক পরিবর্তনের প্রতিধ্বনি

বাংলাদেশে তাঁর সফরের সময় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত ইরানের অবস্থানকে সমর্থন করছেন। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০০ জন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরায়েলবিরোধী ইরানের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং ইরানের প্রতিরোধকে সমর্থন জানিয়েছেন। একজন অধ্যাপক বলেন: “যদি ইরান পরাজিত হয়, তবে গোটা মুসলিম বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে।

মিডিয়ার জন্য এক বিশেষ সুযোগ

কোমের ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের এক শিক্ষক বলেন, ইরানের অবস্থান এখন এতটাই শক্তিশালী যে, এটি মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন, ইরানি মিডিয়া যেন এই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলোকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তুলে ধরে এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও প্রতিরোধের বার্তা আরও শক্তিশালী করে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানসহ উপমহাদেশের দেশগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ইরানের অবস্থানের সঙ্গে একমত ও সহমর্মী।

ইরান-বাংলাদেশ সম্পর্ক: ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার সেতুবন্ধন

হুজ্জাতুল ইসলাম ও মুসলেমিন ড. সাইয়্যেদ মাহদী আলীজাদেহ মুসাভী, যিনি বাংলাদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দপ্তরের প্রতিনিধি, ইরান ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে বলেন:

“আমি বহু আরব ও এশীয় দেশের সফর করেছি, এমনকি আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলেও গিয়েছি। কিন্তু কোথাও বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের মতো ইরানের সঙ্গে এত গভীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য দেখিনি।”

তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতেও এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে এবং দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতায় এগিয়ে যাবে।

ভাষার বন্ধনে হৃদয়ের মিল

তিনি আরও বলেন, এই ঘনিষ্ঠতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভাষা। বাংলা ভাষা বিশ্বের সপ্তম সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা, এবং প্রায় ২ কোটি বাংলাদেশি কর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাংলা ও ফারসি ভাষার মধ্যে প্রায় ৭০০০টি শব্দের মিল রয়েছে, যা দুই জাতির ভাষাগত ঐক্য ও ইতিহাসের গভীরতাকে তুলে ধরে।

বাংলাদেশিদের মধ্যে ইরানের প্রতি রয়েছে এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, যা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশ: মুসলিম বিশ্বের এক উজ্জ্বল প্রদীপ

আলীজাদাহে মুসাভী বলেন, বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যারা ইরানের সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে মুহাররম ও আশুরার দিনে বাংলাদেশে যে আবেগঘন শোকানুষ্ঠান পালিত হয়, তা প্রমাণ করে এই জাতির হৃদয়ে আহলে বাইতের (আ.) প্রতি কতটা গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রয়েছে।

বাংলাদেশে ইরানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: জনসংখ্যার শক্তি, বাণিজ্যের দিগন্ত

বাংলাদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দপ্তরের প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন আলীজাদাহে মুসাভী বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ইরানের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ।” এই দেশটির বাজারে রয়েছে ১৮ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, যা ইরানের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, পাশ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা যুক্ত করলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২৮ কোটি, যা এই অঞ্চলের বাজারকে আরও বিস্তৃত ও সম্ভাবনাময় করে তোলে।

বাংলাদেশ: মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ, সম্ভাবনার ভাণ্ডার

তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশই মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ।” এই বিশাল জনসংখ্যা, বিশেষ করে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ও রপ্তানিমুখী অর্থনীতি, ইরানের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অংশীদার হতে পারে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমরা এখনও এই দেশের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারিনি, অথচ বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে সহযোগিতায় আগ্রহী।”

উপমহাদেশে মিডিয়ার শক্তি: বার্তা পৌঁছানোর সেতু

আলীজাদাহে মুসাভী আরও বলেন, “এই অঞ্চলে মিডিয়ার সম্ভাবনা বিশাল। সংবাদ ও তথ্যের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি জানান, উপমহাদেশে ‘হওজা নিউজ’-এর শাখা: ঐক্যের বার্তা ও সত্যের সেতুবন্ধন

বাংলাদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দপ্তরের প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন আলীজাদাহে মুসাভী বলেছেন, উপমহাদেশে ‘হওজা নিউজ’-এর একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হলে, শিয়া ও সুন্নি আলেমদের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে, এবং এই সম্পর্কের মাধ্যমে অঞ্চলজুড়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটবে।

তিনি বলেন, “এই অঞ্চল, বিশেষ করে উপমহাদেশ, মুসলিম বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের উচিত, এখানে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।”

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার

আলীজাদাহে মুসাভী আরও বলেন, “হওজা নিউজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন। বর্তমানে এই অঞ্চলে আমাদের শত্রুদের প্রভাব কমে এসেছে, যা আমাদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা কাউকে শিয়া বানাতে চাই না। আমাদের দুটি মূল লক্ষ্য— এক, শিয়াদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা, যেন তা আমাদের ভাষায় পৌঁছায়, শত্রুদের অপপ্রচারে নয়। দুই, মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা। কারণ আমরা সবাই মুসলমান, আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে।

মিডিয়ার কৌশল: পরিচয়, সংহতি ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ

তিনি তিনটি মূল কৌশলের কথা বলেন, যা উপমহাদেশে মিডিয়ার ভূমিকা আরও শক্তিশালী করতে পারে:

১. মাযহাবের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা, যেমনটি ইরাকে হয়েছে, তবে উপমহাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের সংহতি আরও জরুরি।

২.অন্য ধর্মের সঙ্গে সংলাপ, বিশেষ করে হিন্দুধর্মের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভারতে এমন কিছু চিন্তাধারা রয়েছে, যারা মুসলমানদের সঙ্গে দার্শনিক ও ধর্মীয় সংলাপে আগ্রহী। তারা আমাদের সঙ্গে ‘ঐক্যতত্ত্ব’ ও অন্যান্য যৌথ বিষয়ে আলোচনা করতে চায়।

৩. এই সংলাপগুলো যদি বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে তা মুসলিম আলেমদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে উঠবে।

একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দুতে মনোযোগ

তিনি বলেন, “আমাদের উচিত, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা। যদি তা সফল হয়, তবে আমাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তা সহায়ক হবে।” তিনি আশ্বাস দেন, “আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত—এই লক্ষ্য অর্জনে যেকোনো সহযোগিতা ও পদক্ষেপ নিতে।”

বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ: হওজা নিউজ‘-এর প্রতি আস্থা

আলীজাদাহে মুসাভী বলেন, আমার কাছে ‘হওজা নিউজ’ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম। আমি যখন অন্য কোনো সূত্র থেকে খবর পাই, তখন তার সত্যতা যাচাই করি ‘হওজা নিউজ’-এর মাধ্যমে।”

তিনি আরও বলেন, “উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশে আমাদের আলেমদের সঙ্গে যেসব সাক্ষাৎ ও কার্যক্রম হয়েছে, তা ‘হওজা নিউজ’-এ দ্রুত ও নিখুঁতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, এই সংবাদমাধ্যম কতটা সচেতন ও সময়োপযোগী।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button