হযরত খাদিজা (সা.আ.) এর সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তির জবাব
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.) ও হযরত খাদিজাতুল কুবরা (সা.আ.)-এর পবিত্র বিবাহ ইসলামী ইতিহাসে এক মহিমান্বিত অধ্যায়। কিন্তু যুগে যুগে কিছু ইতিহাসবিদ ও বর্ণনাকারীর পক্ষপাতদুষ্ট বিবৃতির কারণে তাঁর বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। অথচ প্রামাণ্য সূত্র অনুযায়ী, খদিজা (সা.আ.)-এর বয়স তখন ছিল ২৫ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে—যা নবী করিম (সা.)-এর বয়সের প্রায় সমান।
পবিত্র বিবাহের সময়কাল ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১০ রবিউল আউয়াল হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সা.আ.)-এর বিবাহবার্ষিকী। এই পবিত্র বিবাহ সংঘটিত হয়েছিল নবুয়তের ১৫ বছর আগে।
অনেক ঐতিহাসিক ও হাদীসবিদদের মতে, বিবাহের সময় হযরত খাদিজা (সা.আ.)-এর বয়স ছিল প্রায় ২৫ থেকে ২৮ বছর, এবং মহানবী (সা.) তখন ছিলেন ২৫ বছর বয়সী। অর্থাৎ তাঁদের বয়সে কোনো প্রকৃত ফারাক ছিল না, কিংবা সর্বোচ্চ তিন বছরের ব্যবধান থাকতে পারে।
বয়স নিয়ে বিতর্ক ও তার উৎস
ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম যুগের কিছু সুন্নি ঐতিহাসিক ও হাদীস বর্ণনাকারী, বিশেষত যারা খেলাফতপন্থী ধারার অনুসারী ছিলেন, তাঁরা চাননি যে নবীজির কোনো স্ত্রী আয়েশা (রা.)-এর তুলনায় বেশি মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে পরিচিত হন। তাই তাঁরা কিছু ভিত্তিহীন বর্ণনা ও যুক্তি হাজির করেন, যার মাধ্যমে খদিজা (সা.আ.)-এর বয়সকে ৪০ বছর বলে প্রচার করা হয়।
কিন্তু এই মতটি ছিল সংখ্যালঘু ও দুর্বল সূত্রভিত্তিক; বরং অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্রে খদিজা (সা.আ.)-এর বয়স ২৫ থেকে ২৮ বছর বলা হয়েছে।
সুন্নি ও শিয়া ইতিহাসবিদদের অভিমত
১. আল-বায়হাকী, সুন্নি আলেমদের একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, বলেন, কিছুজন বলেন, খাদিজা (সা.আ.) মৃত্যুর সময় ৬৫ বছর বয়সী ছিলেন, আবার কিছুজন বলেন ৫০ বছর। পরেরটিই সঠিক মত। তিনি আরও উল্লেখ করেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুয়তের ১৫ বছর আগে খাদিজা (সা.আ.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
২. আল-হালাবি বলেন, “খাদিজা (সা.আ.)-এর বয়স তখন ২৫ বছর ছিল।
৩.ইবনে ইমাদ হানবালি তাঁর শাযারাতুজ-জাহাব গ্রন্থে লিখেছেন, “বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ খাদিজা (সা.আ.)-এর বয়স ২৮ বছর বলে মেনে নিয়েছেন।
৪. হাকিম নিশাবুরি ও ইবনে ইসহাক (বিখ্যাত সিরাতকার) — উভয়ের বক্তব্যও একই: খাদিজা (সা.আ.) বিবাহের সময় ২৮ বছর বয়সী ছিলেন।
৫. বালাযুরি, ইবনে সা’দ, যাহাবি, ইরবিলি, ও ইবনে আসাকির — এঁরা সকলেই ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে একই তথ্য উল্লেখ করেছেন।
অতএব, অধিকাংশ গবেষক ও ইতিহাসবিদের মতে, খাদিজা (সা.আ.) নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে বিবাহের সময় ২৫ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে ছিলেন।
কেন ৪০ বছরের মতটি প্রচলিত হলো?
যখন এই প্রমাণগুলো স্পষ্টভাবে খাদিজা (সা.আ.)-এর বয়সকে ৩০ বছরের নিচে নির্দেশ করে, তখন প্রশ্ন ওঠে—কেন তাঁর বয়স ৪০ বছর হিসেবে প্রচার করা হলো?
উত্তরটি সুস্পষ্ট: ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে কিছু বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে এমন বর্ণনা চালু করেন যাতে খাদিজা (সা.আ.)-এর মর্যাদা তুলনামূলকভাবে কমিয়ে দেখা যায়। অথচ ইতিহাসের নিরপেক্ষ পর্যালোচনা এই দাবিকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করে।
খাদিজা (সা.আ.)-এর মহত্ত্ব ও নবীর প্রতি ভালোবাসা
মরহুম রসুলি মহাল্লাতি তাঁর আল-ইস্তেগাসাহ গ্রন্থে লিখেছেন, মক্কার আকাশে তখনও নবুয়তের আলো ছড়িয়ে পড়েনি, কিন্তু এক মহীয়সী নারীর হৃদয়ে ইতিমধ্যেই জেগে উঠেছিল সত্যের স্পন্দন। তিনি ছিলেন খাদিজা (সা.আ.) — কুরাইশের শ্রেষ্ঠ নারী, যাঁর মর্যাদা, সম্পদ ও চরিত্রে ছিল অনন্য দীপ্তি। মক্কার কোনো সম্মানিত নেতা বা অভিজাত ব্যক্তি ছিলেন না যিনি খদিজা (সা.)-এর কাছে প্রস্তাব দেননি। কিন্তু তিনি সকলকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং কেবল মহানবী (সা.)-কে বেছে নেন।
এ কারণে মক্কার নারীরা খাদিজা (সা.আ.)-এর প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে এবং তাঁকে তিরস্কার করে বলে, তুমি তো কুরাইশের বড় বড় নেতাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছ, অথচ মুহাম্মাদ (সা.)—একজন অনাথ ও দরিদ্র ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ করলে!
রসুলি বলেন, যে নারী এত সম্মানিত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁর সম্পর্কে এ বলা যে তিনি এর আগে কোনো আরব পুরুষের স্ত্রী ছিলেন—তা যুক্তিহীন এবং ঐতিহাসিকভাবে অসত্য।
খাদিজা (সা.আ.) ছিলেন কুমারী ও পবিত্রা
ইবনে শহর আশূব লিখেছেন,
أنَّ النبِی تَزوَّجَ بِها وَ کانَتْ عَذْرَاء
নবী করিম (সা.) খাদিজা (সা.আ.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন তিনি ছিলেন কুমারী।
অতএব, তাঁর পূর্বে অন্য কোনো বিবাহের কাহিনি ভিত্তিহীন। ইতিহাসবিদদের মতে, তাঁর নামে যে সন্তানদের উল্লেখ করা হয়, তারা আসলে খাদিজা (সা.আ.)-এর বোন হালার সন্তান, যাদের তিনি নিজের আশ্রয়ে লালনপালন করেছিলেন।
শিয়া ও আধুনিক গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আল্লামা সাইয়্যেদ জাফর মুর্তজা আমেলি বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে ২৫, ৩০, ৩৫, ৪০, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬ বছর বয়সের তথ্য উল্লেখ করলেও বলেন, অধিকাংশ গবেষকই ২৮ বছর বয়সের মতটিকেই সমর্থন করেছেন।
অন্যদিকে, বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. সাইয়্যেদ জাফর শাহিদি বলেন, খাদিজা (সা.আ.)-এর সন্তানদের বয়স বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, তাঁর বয়স ৪০ বছরের নিচেই ছিল।”
তৃতীয় হিজরি শতকের ইতিহাসবিদ ইয়াকুবি বলেন, খাদিজা (সা.আ.) নবীজির সঙ্গে ২৮ বছর বয়সে বিবাহ করেন।
ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক বিশ্লেষণে স্পষ্ট যে, হযরত খাদিজা (সা.আ.) নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে বিবাহের সময় ছিলেন যুবতী ও পূর্ণ সতী। তাঁর বয়স ২৫ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে হওয়াই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মত। যে নারী ইসলামের সূচনালগ্নে নবীজির সবচেয়ে দৃঢ় সহচর, প্রথম বিশ্বাসী ও ত্যাগের প্রতিমূর্তি — তাঁকে ইতিহাসের প্রকৃত আলোয় দেখা সময়ের দাবি।
উম্মুল মুমিনীন খাদিজা (সা.আ.) নবীজির প্রথম ও শ্রেষ্ঠতম স্ত্রী
হযরত খাদিজা (সা.আ.): কুরাইশের মর্যাদাবান কন্যা
হযরত খাদিজা (সা.আ.) ছিলেন খুয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উজ্জা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাবের কন্যা। তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশের উচ্চ বংশোদ্ভূত ও সম্মানিত নারী। কুসাই ইবনে কিলাব, যিনি নবী করিম (সা.)-এর চতুর্থ পুরুষ, ছিলেন তাঁর প্রপিতামহ এবং মক্কার নেতৃত্বে আসীন এক মহান ব্যক্তিত্ব। সুতরাং বংশানুক্রমে হযরত খাদিজা (সা.আ.) ছিলেন নবী করিম (সা.)-এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও নিকটাত্মীয় স্ত্রী।
“তাহেরা” উপাধির কারণ
ঐতিহাসিক “মাওয়াহিব আদ-দুনিয়া” গ্রন্থে বর্ণিত আছে—হযরত খাদিজা (সা.আ.) যুগের নারীদের প্রচলিত অনৈতিক রীতিনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন; তিনি কখনও অশালীনতা, মূর্তি উপাসনা বা জাহেলি সমাজের বিকৃত আচরণে অংশ নেননি। তাঁর চরিত্রের এই নির্মলতা ও পবিত্রতার জন্যই তাঁকে বলা হতো “তাহেরা”—অর্থাৎ, “পবিত্রা নারী”।
প্রস্তাব ও বিবাহের সূচনা
প্রায় সকল ঐতিহাসিকের একমত যে, বিবাহের প্রস্তাব প্রথম দেন হযরত খাদিজা (সা.আ.)। তবে এই প্রস্তাব প্রকাশের দুটি বর্ণনা পাওয়া যায়—
১. হযরত খাদিজা (সা.আ.)-এর সরাসরি প্রস্তাব:
ইবনে হিশাম তাঁর “সিরাতুন নবী” গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, হযরত খাদিজা (সা.আ.) স্বয়ং নবী করিম (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, হে আমার আত্মীয়, আমি তোমার প্রতি—তোমার চরিত্র, সততা, সম্মান, আর আত্মীয়তার কারণে আকৃষ্ট হয়েছি। আমি তোমার সঙ্গে বিবাহ করতে আগ্রহী।”
২. নাফিসা বিনতে মুনিয়ার মাধ্যমে প্রস্তাব:
আরও অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, হযরত খাদিজা (সা.আ.) তাঁর বিশ্বস্ত বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনিয়া-কে প্রেরণ করেন।
নাফিসা নবীজির কাছে এসে বলেন, যদি তোমাকে এমন এক নারীর সঙ্গে বিবাহের আহ্বান জানানো হয়, যিনি সৌন্দর্য, সম্পদ ও মর্যাদায় তোমার সমকক্ষ—তবে কি তুমি গ্রহণ করবে? নবী (সা.) জানতে চান, “তিনি কে? নাফিসা উত্তর দেন, “তিনি খাদিজা ।”
এ কথা শুনে নবীজির পবিত্র মুখে এক মৃদু হাসি ফুটে ওঠে—আর সেই হাসিই ছিল এক পবিত্র সূচনার বার্তা।
চুক্তি ও খুতবা
বিবাহ অনুষ্ঠানে নবীজির চাচা হযরত আবু তালিব (আ.) কুরাইশের নেতৃবৃন্দের সামনে খুতবা পাঠ করেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন, সব প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদের ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধর ও ইসমাইল (আ.)-এর সন্তান করেছেন, এবং আমাদের কাবা ঘর দান করেছেন যাতে মানুষ তাওয়াফ করে।”
এরপর তিনি নবীজির প্রশংসা করে বলেন, “আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব কুরাইশের যেকোনো পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাঁর তুলনা যার সঙ্গেই করা হোক, তিনি মর্যাদায় অধিক।
অবশেষে তিনি ঘোষণা করেন, মুহাম্মাদ (সা.) খাদিজা (সা.আ.)-কে ভালোবাসেন, এবং খাদিজা (সা.আ.) তাঁর প্রতি সমান ভালোবাসা রাখেন।
এইভাবে দুই হৃদয়ের মিলনে, ইসলামি ইতিহাসের প্রথম ও সর্বোচ্চ মর্যাদার ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
মোহরানা ও বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা
ইতিহাসে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) খাদিজা (সা.আ.)-এর মোহরানা নির্ধারণ করেন বারো উকিয়া (প্রতিটি উকিয়া সমান ৪০ দিরহাম)।
কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে, মোহরানা হিসেবে ২০টি উট বা ৫০০ দিরহাম প্রদান করা হয়।
শিয়া আলেম শেখ তাবরেসি, যিনি বিখ্যাত “মাজমা আল-বায়ান” তাফসিরের রচয়িতা, উল্লেখ করেছেন—
খদিজা (সা.)-এর মোহরানা ছিল বারো উকিয়া, এবং নবীজির অন্য সব স্ত্রীর মহরও একই ছিল।
খদিজা (সা.): নবীজির আশ্রয় ও ইসলামের প্রথম সমর্থক
হযরত খাদিজা (সা.আ.) শুধু নবীজির স্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর প্রথম বিশ্বাসী, প্রথম সমর্থক, এবং কষ্টের সময়ে অবিচল সহচর।
তাঁর সম্পদ, প্রজ্ঞা ও ভালোবাসা ইসলামের প্রথম পর্যায়ে নবীজির মিশনকে শক্ত ভিত্তি প্রদান করে।
উম্মুল মুমিনীন খাদিজা (সা.আ.) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য নারী—যিনি ধনসম্পদ নয়, চরিত্রের মহিমায় শ্রেষ্ঠ। তিনি ছিলেন নবী করিম (সা.)-এর হৃদয়ের সান্ত্বনা, ইসলামের প্রথম সমর্থক, এবং পবিত্রতার প্রতীক। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই শিক্ষা দেয়—সত্যিকারের মহিমা আসে ঈমান, পবিত্রতা ও আত্মত্যাগ থেকে।
সূত্রসমূহ:
১. আহমদ ইবনে হোসাইন আল-বায়হাকি, দালায়িলুন নুবুয়্যাহ, খণ্ড ২, পৃ. ৭২
২. হাকিম নিশাবুরি, আল-মুস্তাদরাক, খণ্ড ৩, পৃ. ১৮২
৩. যাহাবি, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খণ্ড ২, পৃ. ১১১
৪. ইবনে শহর আশূব, মানাকিবু আলী ইবনে আবি তালিব, খণ্ড ১, পৃ. ১৩৮–১৫৯
৫. ইরবিলি, কাশফুল গুম্মাহ, খণ্ড ২, পৃ. ২৭৪
৬. ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, খণ্ড ১, পৃ. ১৮৯
৭. সাইয়্যেদ হাশেম রাসুলি মহাল্লাতি, ইসলামের বিশ্লেষণধর্মী ইতিহাসের পাঠ উইকি শিয়া ও হোজা নিউজ এজেন্সি



