কুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

কীভাবে সূরা ফাতহ অতীতের বিজয় এবং ভবিষ্যতের সাফল্যের ঐশী সুসংবাদ হয়ে ওঠে?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: সুরা ফাতহ ইসলামের ইতিহাসের এক অত্যন্ত সংবেদনশীল মুহূর্তে—হুদাইবিয়ার সন্ধির পর—নাজিল হয়। এই সুরা শুধু ঐতিহাসিক বিজয়ের কথা বলে না, বরং বর্তমান সময়ের জন্যও গভীর বার্তা ও আশার আলো বহন করে। আজকের সংকটপূর্ণ সময়ে, যখন মুসলিম উম্মাহ জুলুম ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ দেখাচ্ছে, তখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতগুলো পুনরায় পাঠ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সুরা ফাতহ ও সুরা নাসর—এই দুটি সুরা মুমিনদের বিজয় ও আল্লাহর সাহায্যের সুসংবাদ বহন করে। বর্তমান প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য এগুলো পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে পারে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ি সম্প্রতি সুরা ফাতহ ও নাসর নিয়মিত পাঠ, দোয়া তাওয়াসসুল এবং সাহিফা সাজ্জাদিয়ার পাঠের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন, যা প্রতিরোধের জয় ও অগ্রগতির জন্য সহায়ক।

হুজ্জাতুল ইসলাম ও মুসলিমিন মাহদী রুস্তমনেজাদ, কোরআন ও হাদিসের গবেষক, এই সাক্ষাৎকারে সুরা ফাতহের তাৎপর্য ও বর্তমান পরিস্থিতিতে এর ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন।

 সুরা ফাতহের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বার্তা

সূরাটি হিজরির ষষ্ঠ বছরে, হুদাইবিয়ার সন্ধির পর নাজিল হয় বলে শিয়া ও সুন্নি মুফাসসিরদের অধিকাংশের মত। আল্লামা তাবাতাবায়ী (রহ.) বলেন, সুরার বিষয়বস্তু হুদাইবিয়ার ঘটনার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ঐ ঘটনার পরই এটি নাজিল হয়েছে বলে বহু প্রাচীন সূত্রে উল্লেখ আছে।

সুরাটি শুরু হয় এই আয়াত দিয়ে: “إِنَّا فَتَحْنَا لَکَ فَتْحًا مُبِینًا” নিশ্চয়ই আমরা তোমার জন্য এক সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি। (সূরা ফাতহ, আয়াত ১)

এই আয়াত একটি বড় গৌরবময় বিজয়ের ঘোষণা। সুরার বিষয়বস্তু শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং তাদের বিরোধিতাকারী মুনাফিকদের জন্যও বার্তা বহন করে। এটি অতীতের বিজয় যেমন হুদাইবিয়ার সন্ধি, তেমনি ভবিষ্যতের বিজয়—যেমন মক্কা বিজয়—উল্লেখ করে।

সুরার মধ্যে “فَتْحًا قَرِیبًا” (নিকটবর্তী বিজয়) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের বিজয়ের প্রতিশ্রুতি নির্দেশ করে। অনেক মুফাসসির মনে করেন, এটি মক্কা বিজয়ের ইঙ্গিত, যা এই সুরা নাজিলের দুই বছর পর বাস্তবায়িত হয়।

হুদাইবিয়ার সন্ধিকে মক্কা বিজয়ের ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়। যদি ঐ শান্তিচুক্তি না হতো, তাহলে মক্কা বিজয়ও সম্ভব হতো না। তাই সুরা ফাতহ অতীত ও ভবিষ্যতের বিজয়ের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করে।

সূরার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক

১.সাকিনা বা শান্তি: সুরাটি মুমিনদের অন্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও স্থিরতা নাজিল হওয়ার কথা বলে।

২. বাইয়াতুর রিদওয়ান:এই সুরায় অন্তত দুইবার “বাইআত” শব্দ এসেছে, যা নবী (সা.)-এর সঙ্গে সাহাবিদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি বোঝায়।

৩.নবী ও সাহাবিদের চরিত্র

সুরা ফাতহ: অতীত ও ভবিষ্যতের বিজয়ের বার্তা, মুমিনের আশার আলো

রেওয়ায়েতে এসেছে, সুরা ফাতহের কিছু আয়াত—বিশেষ করে “إِنَّا فَتَحْنَا لَکَ فَتْحًا مُّبِینًا” (নিশ্চয়ই আমরা তোমার জন্য এক সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি)—নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় আয়াত গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। এই সুরার বিষয়বস্তু এমনভাবে সাজানো যে তা শুধু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নয়, বর্তমান সময়ের সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।

যেমন সেই সময় মুসলমানরা অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলি ও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, আজও মুসলিম সমাজ একই ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সে সময় যেমন ঈমানকে দৃঢ় করতে বাইআত (আনুগত্যের অঙ্গীকার) ও আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন ছিল, আজও তেমনই প্রয়োজন রয়েছে।

সুরা ফাতহ আল্লাহর নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি, মুমিনদের দৃঢ়তা এবং ভবিষ্যতের বিজয়ের বার্তা বহন করে। এটি প্রমাণ করে যে—আল্লাহর নিয়ম ও পদ্ধতি ইতিহাসের বিভিন্ন সংকটময় সময়ে একইভাবে কার্যকর এবং প্রাসঙ্গিক।

এই সুরার তেলাওয়াত সবসময়ই সুপারিশ করা হয়েছে, কারণ এটি চোখে আশার আলো জাগায় এবং বিজয়ের সুসংবাদ দেয়। এটি যেমন অতীতের বিজয় (যেমন হুদাইবিয়ার সন্ধি) সম্পর্কে বলে, তেমনি ভবিষ্যতের বিজয় সম্পর্কেও আশ্বাস দেয়। এক কথায়, এটি দুই বিজয়ের মাঝে” অবস্থান করে—একদিকে অতীতের বাস্তবতা, অন্যদিকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সুরার পাঠ অত্যন্ত উপযোগী—একদিকে ইতোমধ্যে অর্জিত বিজয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা, অন্যদিকে ভবিষ্যতের বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি। বিশেষ করে সেই বিজয়, যা ইনশাআল্লাহ, সম্পূর্ণভাবে দখলদার ও জালিম শক্তির পতন ঘটাবে।

এরপর নাজিল হওয়া সুরা হলো সুরা নাসর, যেখানে বলা হয়েছে:

إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ وَرَأَیْتَ النَّاسَ یَدْخُلُونَ فِی دِینِ اللَّهِ أَفْوَاجًا ،فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّکَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ کَانَ تَوَّابًا (যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসে, তখন তুমি দেখবে মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে………)

এই আয়াত আমাদের সেই চূড়ান্ত বিজয়ের কথা বলে, যা মানুষের হৃদয়ে ঈমান জাগিয়ে তোলে এবং আল্লাহর প্রশংসা ও ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।

সুরা ফাতহ আমাদের সেই পূর্ণাঙ্গ বিজয়ের আশায় উজ্জীবিত করে, যা আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যতদিন না আমরা সেই অবস্থানে পৌঁছাই, ততদিন এই সুরার তেলাওয়াত আমাদের শক্তি ও আশার উৎস হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button