কুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

আল্লাহ কে কি চোখে দেখা সম্ভব?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: মানবজীবনের গভীরতম প্রশ্নগুলোর একটি হলো—আল্লাহকে কি চোখে দেখা যায়? এই প্রশ্ন শুধু যুক্তির নয়, বরং ঈমান, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার গভীর স্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত।

 কালামশাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলামী কালামশাস্ত্র (আকীদা ও বিশ্বাসের জ্ঞান) বলছে—আল্লাহকে চোখে দেখা যায় না, কারণ চোখে দেখার জন্য বস্তুটির শরীর, স্থান, দিক এবং আলো থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহ শরীরধারী নন, তিনি কোনো স্থানে সীমাবদ্ধ নন, কোনো দিকেও অবস্থান করেন না। তাই তাঁকে চোখে দেখা সম্ভব নয়।

কুরআনেও বলা হয়েছে:

«لا تُدرِکهُ الأبصارُ وَ هُوَ یُدرِکُ الأبصارَ وَ هُوَ اللَّطیفُ الخبیرُ»

চোখ তাঁকে ধরতে পারে না, কিন্তু তিনি চোখকে ধরতে পারেন। তিনি সূক্ষ্মদর্শী ও সবকিছু জানেন।(সূরা আন‘আম, আয়াত ১০৩)

 হযরত মূসার (আ.) ঘটনা

যখন হযরত মূসা (আ.) আল্লাহর দর্শন কামনা করেন—“হে প্রভু, নিজেকে আমাকে দেখাও, আমি তোমাকে দেখতে চাই”—তখন অনেক মুফাসসির বলেন, মূসা (আ.) নিজে জানতেন যে আল্লাহকে দেখা যায় না। কিন্তু তাঁর জাতি, বনী ইসরাঈল, জেদ করে বলেছিল:

হে মূসা! আমরা তোমায় বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখি। (সূরা বাকারা, আয়াত ৫৫)

এই জেদের ফলেই তারা বজ্রাঘাতে ধ্বংস হয়। এরপর তারা মূসাকে অনুরোধ করে যেন তিনি আল্লাহর কাছে দর্শনের আবেদন করেন, যাতে আল্লাহ নিজেই না বলে দেন এবং তারা সন্তুষ্ট হয়।

দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতে

অনেক চিন্তাবিদ ও আধ্যাত্মিক মুফাসসির বলেন—মূসা (আ.) আল্লাহর দর্শন বলতে বাহ্যিক চোখে দেখার কথা বলেননি। তিনি ছিলেন একজন মহান নবী, যিনি কখনো মূর্তিপূজার আবেদনে সাড়া দেননি। তাই তাঁর এই আবেদন ছিল আধ্যাত্মিক উপলব্ধির জন্য—যাকে কুরআনে বলা হয় “লিকায় আল্লাহ” «لقای خدا» বা “প্রভুর দিকে দৃষ্টিপাত।

যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:

সেদিন কিছু মুখমণ্ডল হবে উজ্জ্বল, তারা তাদের প্রভুর দিকে তাকাবে।” (সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ২২–২৩) “যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং আল্লাহর ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।” (সূরা কাহফ, আয়াত ১১০)

এই “দেখা” বাহ্যিক নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে হৃদয়ের উপলব্ধি। যেমন কেউ বলে, “আমি বুঝতে পারছি আমি এটা ভালোবাসি”—এটা চোখে দেখা নয়, বরং হৃদয়ের অনুভব।

 আধ্যাত্মিক দর্শন: ‘শহুদে ক্বালবি’

আধ্যাত্মিক ভাষায় একে বলা হয় ‘শহুদে ক্বালবি’—অর্থাৎ হৃদয় দিয়ে আল্লাহর সৌন্দর্য ও মহিমা অনুভব করা। এই উপলব্ধি মানুষের অন্তরের পবিত্রতা ও ঈমানের গভীরতার ওপর নির্ভর করে।

ইমাম রেজা (আ.) বলেন: “তোমরা আল্লাহকে দেখতে পার না, কারণ তোমাদের গুনাহই তোমাদের ও আল্লাহর মাঝে পর্দা।”

মাওলানা রুমি তাঁর মসনবিতে বলেন:

“প্রিয়তমের সৌন্দর্যে নেই কোনো পর্দা, পথের ধুলো সরাও, তাহলেই দেখতে পাবে।”

 মূসার অজ্ঞান হওয়া: এক জ্যোতির্ময় মুহূর্ত

আল্লাহ মূসাকে বলেছিলেন: তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও, যদি তা স্থির থাকে, তবে তুমি আমাকে দেখতে পারবে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত ১৪৩)

আল্লাহর জ্যোতি পাহাড়ে প্রকাশিত হলে, পাহাড় ধ্বংস হয়ে যায় এবং মূসা (আ.) অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এটি সাধারণ ভয় নয়, বরং আল্লাহর জ্যোতির মহিমা ও গম্ভীরতা তাঁকে মুগ্ধ করে দেয়।

মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেন—মূসা (আ.) হয়তো দুনিয়াতেই পূর্ণ আধ্যাত্মিক দর্শন চেয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ বুঝিয়ে দেন—এই দুনিয়ায় তা সম্ভব নয়। কারণ দুনিয়ায় মানুষ শরীর ও বস্তুগত সীমায় আবদ্ধ।

কিয়ামতের দিন, যখন আত্মা মুক্ত হবে, তখন পূর্ণ শহুদের মাধ্যমে আল্লাহর সৌন্দর্য ও মহিমা অনুভব করা যাবে।

 আহলে বাইতের বাণী

ইমাম আলী (আ.) বলেন: আমি সেই আল্লাহর ইবাদত করি, যাকে আমি দেখেছি। তবে এই দেখা চোখ দিয়ে নয়, বরং ঈমানের আলোয় হৃদয় দিয়ে।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেন: যখন মূসা (আ.) আল্লাহর জ্যোতি দেখতে চাইলেন, আল্লাহ ফেরেশতা ‘কিরুবিন’-কে নির্দেশ দেন, সে জ্যোতির প্রকাশ ঘটায়, যা পাহাড়কে ধ্বংস করে দেয়।

আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেন—আল্লাহর কাজগুলো যেমন রিজিক দেওয়া মিকাইলের মাধ্যমে, ওহী দেওয়া জিবরাইলের মাধ্যমে, তেমনি জ্যোতির প্রকাশও হয় ফেরেশতার মাধ্যমে।

ইমাম কাজিম (আ.) বলেন: আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টি মধ্যে কোনো পর্দা নেই, পর্দা হলো—সৃষ্টির নিজের সীমাবদ্ধতা।

আল্লাহর দর্শন একটি আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, বাহ্যিক চোখের বিষয় নয়। এটি হৃদয়ের পবিত্রতা, ঈমানের গভীরতা এবং আত্মার জাগরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। যারা এই পথে অগ্রসর হয়, তারা একদিন সেই সৌন্দর্য ও মহিমার ঝলক দেখতে পায়—যা চোখে নয়, হৃদয়ে প্রতিফলিত হয়।

পাদটীকা

১. আব্দুল্লাহ জাওয়াদী আমুলি, কুরআনের বিষয়ভিত্তিক তাফসির, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ১৪২, কোম, এসরা প্রকাশনা কেন্দ্র, প্রথম সংস্করণ, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ।

২. মাওলানা রুমি, মসনবী মানবী, চতুর্থ খণ্ড, কবিতা ২৪৮৪ থেকে ২৪৮৬ পর্যন্ত।

৩. তাফসিরে আল-মিজান অনুবাদ, পৃষ্ঠা ৩৬৮; সাইয়্যেদ রাযী, নাহজুল বালাগা, গবেষক: সুবহি সালেহ, পৃষ্ঠা ২৫৮, খুতবা ১৭৯, কুম, হিজরত প্রকাশনী, প্রথম সংস্করণ, ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ।

৪. তাফসিরে আল-মিজান অনুবাদ, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৩৭৭।

৫. উপরোক্ত উৎস (তাফসিরে আল-মিজান)।

৬. তাফসিরে নমুনা, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৫৭।

৭. শাইখ সাদূক, তাওহিদ, গবেষক ও সম্পাদনা: হাশেম হোসেইনি, পৃষ্ঠা ১৭৯, কোম, ইসলামিক পাবলিকেশন অফিস, প্রথম সংস্করণ, ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button