ইতিহাসবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

স্ন্যাপব্যাক: ইউরোপের গত এক দশকের সবচেয়ে ব্যয়সাধ্য কৌশলগত ভুল

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইরানকে ঘিরে ইউরোপের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ—স্ন্যাপব্যাক নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল—শুধু মধ্যপ্রাচ্য নীতির নতুন অধ্যায় নয়, বরং ইউরোপীয় পররাষ্ট্রনীতির আত্মপরিচয় সংকটেরও প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ানীতি অনুসরণ করে তেহরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ইউরোপের নিজস্ব কূটনৈতিক সক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এক দশকের বিনিয়োগ, দীর্ঘ আলোচনা ও বহুপাক্ষিক কূটনীতির প্রতিশ্রুতির পর, “স্ন্যাপব্যাক” এখন ইউরোপের জন্য এমন এক প্রতীক, যা ব্যর্থ কূটনীতি, হারানো বিশ্বাসযোগ্যতা ও কৌশলগত বিভ্রান্তির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

ইউরোপের ব্যর্থ “চাপের নীতি” এবং হারানো কূটনৈতিক প্রভাব

স্ন্যাপব্যাক, যা না কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে পেরেছে, না ইউরোপের জন্য দৃশ্যমান কোনো সাফল্য এনেছে, আজ ইউরোপের গত এক দশকের সবচেয়ে ব্যয়সাধ্য কৌশলগত ভুলে পরিণত হয়েছে।

২০২৫ সালের ২৭ আগস্ট ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে “স্ন্যাপব্যাক” প্রক্রিয়া সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয় এবং ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে তা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর ঘোষণা করে। এর ফলে, ইরানের ওপর জাতিসংঘের পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞাগুলি পুনর্বহাল হয়।

কিন্তু প্রত্যাশার বিপরীতে, এই পদক্ষেপ কোনো নতুন কূটনৈতিক অগ্রগতি বা প্রতিরোধমূলক ফলাফল আনেনি। বরং আন্তর্জাতিক পরিসরে এর বৈধতা ও কৌশলগত যৌক্তিকতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।

প্রশ্নটি এখন এই: স্ন্যাপব্যাক কি ইউরোপের জন্য একটি সফল কূটনৈতিক কৌশল ছিল, নাকি এটি ইরান–পশ্চিম সম্পর্কের একটি নেতিবাচক ও পশ্চাদপদ পদক্ষেপ?

বিশ্বের বহু বিশ্লেষণাত্মক প্রতিষ্ঠান ও থিঙ্কট্যাংক মনে করছে, ইউরোপ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তার কূটনৈতিক শক্তি হ্রাস করেছে, বৈধতা হারিয়েছে এবং নিজেকে এক জটিল ভূরাজনৈতিক অচলায়তনে ফেলে দিয়েছে।


ইতালির আন্তর্জাতিক বিষয়ক ইনস্টিটিউট (IAI): “কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কফিনে শেষ পেরেক”

ইতালির আন্তর্জাতিক বিষয়ক ইনস্টিটিউট (IAI) তাদের প্রতিবেদনে, “ইরানের বিরুদ্ধে স্ন্যাপব্যাক সক্রিয়করণে ইউরোপের তিক্ত বিদ্রূপ”, এই পদক্ষেপকে বর্ণনা করেছে “ইরানের সঙ্গে পরমাণু কূটনীতির কফিনে শেষ পেরেক” হিসেবে।

IAI-এর মতে, ইউরোপ নিজেই ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা প্রত্যাহারের পরও তার প্রতিশ্রুতি—বিশেষত অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও জাতীয় পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অঙ্গীকার—রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ত্রয়ী ইউরোপীয় দেশ (E3) আর আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে স্ন্যাপব্যাক সক্রিয় করার অধিকার রাখে না।
প্রতিবেদনটি উল্লেখ করে, “যে পক্ষ নিজেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে, তার অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার নৈতিক ও আইনি ভিত্তি থাকতে পারে না।”


ইউরোপীয় পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিষদ (ECFR): “ইউরোপের বিপজ্জনক জুয়া”

ইউরোপীয় পররাষ্ট্র সম্পর্ক পরিষদ (ECFR) তার প্রবন্ধ “ঝুঁকির জুয়া: স্ন্যাপব্যাকের পর ইরানের মুখোমুখি ইউরোপ”–এ সতর্ক করেছে যে, ইউরোপ তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক হাতিয়ারটি হারিয়েছে।

প্রতিবেদনটি জানায়, “এই সিদ্ধান্তের ফলে ইউরোপ এখন দুই বিপরীত পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে—একদিকে নতুন সংলাপের সুযোগ তৈরি করা, অন্যদিকে কঠোর চাপ অব্যাহত রাখা। কিন্তু দ্বিতীয় পথটি কৌশলগতভাবে আত্মঘাতী হতে পারে।”

ECFR-এর বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, স্ন্যাপব্যাক ইউরোপের আইনি ও নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মর্যাদাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ইরান, রাশিয়া ও চীন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, ইউরোপীয় ত্রয়ী নিজেরাই পরমাণু চুক্তি লঙ্ঘন করেছে এবং তাই ইরানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তোলার বৈধতা তাদের নেই।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের ফলে না ইরান পিছিয়ে এসেছে, না আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার সঙ্গে তার সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বরং ফলাফল হয়েছে বিপরীত—বিশ্বাসহীনতা ও কূটনৈতিক ক্ষতি উভয়ের জন্যই।
একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত তদারকি সীমিত হয়েছে এবং ইরান আরও ঘনিষ্ঠভাবে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে—যেমন নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মস্কোর সঙ্গে সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে চীন ও পাকিস্তানের প্রতি ঝোঁক।

ECFR-এর মতে, এই পরিস্থিতি বৈশ্বিক শক্তিগুলির মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে দিয়েছে এবং বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে ক্রমে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সংঘাতমুখী পথে ঠেলে দিয়েছে।


স্টিমসন সেন্টার (ওয়াশিংটন): “আস্থার ফাটল আরও গভীর হয়েছে”

বারবারা স্লাভিন, ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টার–এর বিশ্লেষক, তার মন্তব্যে বলেছেন,
“স্ন্যাপব্যাক সক্রিয় হওয়ার ফলে ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে যে আস্থার ফাটল তৈরি হয়েছিল, তা এখন আরও গভীর ও স্থায়ী রূপ নিয়েছে।”

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা চুক্তি ত্যাগই ছিল অবিশ্বাসের সূচনা। ইউরোপের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সেই অবিশ্বাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এবং ভবিষ্যতের কূটনৈতিক পথ আরও জটিল করেছে।


“বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস”: “এই প্রতিরক্ষা বৈশ্বিক শৃঙ্খলাকে দুর্বল করে”

বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস তাদের প্রতিবেদনে “ইরানের বিরুদ্ধে ইউরোপের স্ন্যাপব্যাক কেন ব্যর্থ হবে” শিরোনামে বলেছে, এই পদক্ষেপ কূটনৈতিক পরিবেশকে সংকুচিত করেছে, উত্তেজনা বাড়িয়েছে এবং পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করেছে।

প্রতিবেদনটি উল্লেখ করে, “ইরানের ওপর মূল অর্থনৈতিক চাপ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয়িক নিষেধাজ্ঞা থেকেই আসে; ইউরোপীয় স্ন্যাপব্যাকের বাস্তব প্রভাব নগণ্য। কিন্তু এটি বৈশ্বিক পরমাণু শৃঙ্খলা ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিকে দুর্বল করে।”

প্রতিবেদনটির ভাষায়,

“স্ন্যাপব্যাককে একধরনের প্রতিরক্ষামূলক নীতি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, অথচ এটি বাস্তবে আন্তর্জাতিক আইনকে ক্ষয় করছে। এটি ইরানের আচরণ পরিবর্তন করে না, বরং বৈশ্বিক কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করে।”


কার্নেগি আন্তর্জাতিক শান্তি ফাউন্ডেশন: “নতুন পারমাণবিক সংকটের সতর্কবার্তা”

কার্নেগি আন্তর্জাতিক শান্তি ফাউন্ডেশন তার প্রতিবেদনে “ইরানের নতুন পারমাণবিক সংকট ঠেকাতে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে” শিরোনামে সতর্ক করেছে যে,
স্ন্যাপব্যাকের সক্রিয়তা ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে, যা শুধু পরমাণু বিষয়ক উত্তেজনা নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলবে।

প্রতিবেদনটি বলছে, যদি ইউরোপ শুধুমাত্র চাপের নীতিতে নির্ভর করে এবং কোনো বাস্তব কূটনৈতিক সমাধান না দেয়, তবে তারা ভবিষ্যতের আলোচনায় তাদের প্রভাব হারাবে।
কার্নেগির মতে,

“শুধু চাপ প্রয়োগ করা, কিন্তু ফল না পাওয়া মানে ইউরোপ নিজের কূটনৈতিক লিভারকে নিস্তেজ করে ফেলছে এবং ভবিষ্যতের গঠনমূলক সংলাপের পথ রুদ্ধ করছে।”


আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাংক নেটওয়ার্ক: “পরাশক্তিদের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট”

আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাংক সমাজের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমর্থন পেলেও চীন ও রাশিয়া এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। ফলে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলির মধ্যে এক নতুন বিভাজন তৈরি হয়েছে।

রিপোর্টটি সতর্ক করেছে, ইরান সম্ভবত “পাল্টা চাপের কৌশল” অবলম্বন করতে পারে — যেমন অবৈধভাবে ইরানি তেল পরিবহনকারী জাহাজ আটকানো বা গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটে ঝুঁকি বৃদ্ধি করা।


ইউরোপের বহুপাক্ষিক কূটনীতির পরাজয়

যে স্ন্যাপব্যাক ইউরোপের চোখে ইরানের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার ছিল, বাস্তবে সেটি পরিণত হয়েছে বহুপাক্ষিক কূটনীতির বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষায়—যেখানে ইউরোপ স্পষ্টভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

যা একসময় “চাপের লিভার” হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত তেহরানের সঙ্গে অবিশ্বাস বাড়িয়েছে, তদারকি সীমিত করেছে এবং ইরানের পূর্বমুখী সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে।

রোম থেকে ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস থেকে লন্ডন—বিশ্লেষকরা এককণ্ঠে বলছেন, ইউরোপ তার কূটনৈতিক ও আইনি মূলধন নষ্ট করেছে এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের একপাশে ও চীন–রাশিয়ার অন্যপাশে এক দ্বিধাগ্রস্ত ও দুর্বল অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে।


শেষ বিশ্লেষণ

চিত্রটি স্পষ্ট: স্ন্যাপব্যাক না প্রতিরোধ গড়েছে, না ইউরোপের জন্য কোনো বাস্তব লাভ বয়ে এনেছে। বরং এটি ইউরোপের গত এক দশকের সবচেয়ে ব্যয়সাধ্য কৌশলগত ভুলে পরিণত হয়েছে।

আজ ইউরোপ এক মৌলিক প্রশ্নের সম্মুখীন— “তারা কি অকার্যকর চাপের নীতিতে অটল থেকে আরও প্রান্তিক হয়ে পড়বে, নাকি বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে নিজের ভূমিকা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে হারানো বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্নির্মাণ করবে?”

এই প্রশ্নের উত্তরই শুধু ইরান–পশ্চিম সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনৈতিক স্থাপত্যে ইউরোপের অবস্থানও নির্ধারণ করবে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button