কুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

ইসলামী হাদিসে নবুয়তের দর্শন: ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও তাৎপর্য

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামী বর্ণনা ও হাদিসে নবুয়তের উদ্দেশ্য শুধু অতীতের ঘটনা নয়; এটি মানুষের নৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির চিরন্তন নির্দেশিকা। নবুয়তের মাধ্যমে মানুষকে কল্যাণ, নৈতিকতা, সত্যের পথে পরিচালনা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য শেখানো হয়।

নবুয়তের দর্শন ও উদ্দেশ্য

১. আহ্বান গ্রহণ ও সাফল্যের প্রতিশ্রুতি

যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তার আহ্বান প্রকাশ করলেন, কুরাইশের প্রধানরা আবু তালিবের কাছে অভিযোগ জানালেন, তারা বললেন:

আপনার ভাইয়ের ছেলে আমাদের ব্যঙ্গ করে, আমাদের দেবতাদের নিন্দা করে, যুবক সমাজকে প্রলুব্ধ করছে এবং আমাদের সমাজে বিভাজন ঘটাচ্ছে। যদি এটি ধন সংক্রান্ত কারণের জন্য হয়, আমরা তাকে এত ধন দেব যাতে তিনি কুরাইশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হবেন; এমনকি আমরা তাকে আমাদের প্রধান হিসেবেও গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

নবীজী (সা.) উত্তর দেন:

لَوْ وَضَعُوا الشَّمْسَ فِى يَمينِى وَ الْقَمَرَ فِى یَسارِى مَا اَرَدْتُهُ وَ لكِنْ كَلِمَةٌ يُعْطُونِيهَا يَمْلِكُونَ بِهَا الْعَرَبُ وَ تَدِينُ بِهَا الْعَجَمُ وَ یَكُونُونَ مُلُوكاً فِى الْجَنَّةِ فَقَالَ لَهُمْ اَبُوطَالِبُ ذلِكَ فَقَالُوا: نَعَمْ وَ عشرَ كَلِمات فَقَالَ لَهُمْ رَسُول الله: تَشْهَدُونَ اَنْ لاَ اِلهَ اِلاّ اللهُ وَ اَنِّى رَسُولُ اللهِ

এই বর্ণনা দেখায় নবীর আহ্বান গ্রহণ করলে মানুষ পাবে দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য, মর্যাদা, স্বাধীনতা ও আনন্দময় জীবন।

২. নবুয়তের উদ্দেশ্য: কল্যাণ ও মঙ্গল

ইমাম সাদিক (আ.) হাদিসে বলেন:

যখন আমরা প্রমাণ করি যে একজন স্রষ্টা আছে, যিনি আমাদের এবং সমস্ত সৃষ্টির চেয়ে উচ্চতর, জ্ঞানী ও পরিপূর্ণ, এবং যিনি চোখে দেখা যায় না বা স্পর্শযোগ্য নয়, তখন তিনি তার বান্দাদের মধ্যে দূত প্রেরণ করেন। তারা তাদের কল্যাণ ও মঙ্গল নির্দেশ করে এবং যা ধরে রাখবে তা বাঁচাবে, আর যা এড়াবে তা ধ্বংস করবে।”
وَ یَدُلُّونَهُمْ عَلَى مَصَالِحِهِمْ وَ مَنَافِعِهِمْ وَ مَا بِهِ بَقَائُهُمْ وَ فِى تَرْكِهِ فَنَائُهُمْ

৩. ফিতরাতের চুক্তি ও নৈতিক শিক্ষা

নাহজুল বালাগায় আলী (আ.) উল্লেখ করেছেন:

আল্লাহ তার দূত ও নবীদের প্রেরণ করেছেন, যাতে তারা ফিতরতের চুক্তি স্মরণ করায়, মানুষকে ভুলে যাওয়া অনুগ্রহ মনে করায় এবং নবীদের মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধি ও জ্ঞানকে উন্মোচিত করে।

فَبَعَثَ فيهِمْ رُسُلَه وَ وَاتَرَ اِلَيْهِمْ اَنْبِيَائَهُ، لِيَسْتَاْدُوهُمْ مِيثاقَ فِطْرَتِهِ وَ يُذَكِّرُوهُمْ مَنْسِىَّ نِعْمَتِهِ وَ يَحْتَجُّوا عَلَيْهِمْ بِالتَّبْلِيغِ وَ يُثِيرُوا لَهُمْ دَفَائِنَ الْعُقُولِ

৪. নৈতিকতা ও চরিত্রের পূর্ণতা

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

«اِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ صَالِحَ الاَخْلاقِ»
(“আমি প্রেরিত হয়েছি যাতে নৈতিকতা পূর্ণ করতে পারি।”)

একই অর্থে আরও একটি বর্ণনা:

«بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الاَخْلاَقِ»
(“আমি প্রেরিত হয়েছি যাতে নৈতিক মহত্ত্ব সম্পূর্ণ করতে পারি।”)

৫. সেবা ও আল্লাহর পথে আহ্বান

ফুরূ’ কাফিতে আলী (আ.) উল্লেখ করেছেন:

আল্লাহ মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে সত্যের বার্তা নিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি মানুষকে মানব-দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানান। তিনি মানুষকে পার্থিব চুক্তির বদলে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের দিকে ডাকেন, মানুষের আদেশ-নির্দেশের পরিবর্তে আল্লাহর বিধান মেনে চলার পথে পরিচালিত করেন এবং মানুষের কর্তৃত্ব থেকে বের করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে আনেন। তিনি ছিলেন সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী এবং আল্লাহর অনুমতিতে এক আলোকবর্তিকা, যিনি অন্ধকারে পথ দেখান।

اَمّا بَعْدُ فَاِنَّ اللهَ تَبَارَكَ وَ تَعَالى بَعَثَ مُحَمَّداً بِالْحَق لِيُخْرِجَ عِبَادَهُ مِنْ عِبَادَةِ عِبادِهِ … وَ سِراجاً مُنِيراً

উপসংহার

ইসলামী হাদিসে নবুয়তের দর্শন অন্তর্ভুক্ত করে:

১.দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও সাফল্য

২.মানুষের কল্যাণ, স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা

৩.ফিতরাতের চুক্তি স্মরণ ও ভুলে যাওয়া অনুগ্রহের পুনঃস্মরণ

৪.নৈতিকতা ও চরিত্রের পূর্ণতা

৫.আল্লাহর পথে সঠিক উপাসনা ও আনুগত্যের আহ্বান

নবুয়ত কেবল অতীতের ঘটনা নয়; এটি মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনের জন্য চিরন্তন নির্দেশিকা।

সূত্র

১- তাফসীরে নূরুল সাকালাইন

    • লেখক: হুযইজি, আব্দুল আলি বিন জুমা
    • সম্পাদনা: রাসুলি, হাশেম
    • প্রকাশক: আসমাইলিয়ান, কুম, ১৪১৫ হিজরি
    • খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৪৪২, হাদিস: ৭

তাফসীরে আল-কুম্মি

    • লেখক: আলী বিন ইব্রাহিম
    • সম্পাদনা: জাজায়েরি, তাইয়েব
    • প্রকাশক: দারুল কিতাব, কুম, ১৪০৪ হিজরি
    • খণ্ড:২, পৃষ্ঠা: ২২৮

২- আল-কাফি

    • লেখক: কুলাইনি, মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব বিন ইসহাক
    • সম্পাদক/পরীক্ষক: গফফারি, আলী আকবর ও আখুন্দি, মুহাম্মদ
    • প্রকাশক: দারুল কিতাব আল-ইসলামিয়া, তেহরান,১৪০৭ হিজরি, ৪র্থ সংস্করণ
    • খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৬৭, “কিতাবুল হুজ্জা”, باب الاضطرار الى الحجة, হাদিস: ১

৩- নাহজুল বালাগা

    • লেখক: শরীফ রদী, মুহাম্মদ বিন হুসেইন
    • সম্পাদক: সালেহ্ আস-সবহী
    • প্রকাশক: দারুল হিজরাহ, কুম, ১৪১৪ হিজরি
    • খুতবা: ১

৪- আল-তাবাকাতুল কুবরা

    • লেখক: ইবনু সাঅদ, মুহাম্মদ বিন সাঅদ
    • সম্পাদক: আতআ, মুহাম্মদ বিন আব্দুলকাদের
    • প্রকাশক: দারুল কিতাব আল-ইলমিয়াহ, বেইরুত
    • খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৯২.

৫- কঞ্জুল আমাল ফি সুনানিল আকওল ওয়াল আফ‘আল

    • লেখক: মুত্তাকী, আলী বিন হুসামুদ্দিন
    • সম্পাদক: হায়ানি, বকরী, সাকা, সফওয়া
    • প্রকাশক: মুসাসা আল-রাসালা, বেইরুত,১৪০৯ হিজরি
    • খণ্ড: ১১, পৃষ্ঠা: ৪২০, হাদিস:৩১৯৬৯।

৬- আল-কাফি

    • পূর্বোক্ত সূত্রের খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৩৮৬, হাদিস: ৫৮৬

৭- পায়ামুল কোরআন

    • লেখক: নাসের মাকারেম শিরাজী, সহযোগী: কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম
    • প্রকাশক: দারুল কিতাব আল-ইসলামিয়া, তেহরান, ১৩৭৬ শন, ষষ্ঠ সংস্করণ
    • খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ৩৮।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button