কুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

অপবিত্র দৃষ্টি হৃদয়কে অসুস্থ করে তোলে

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১২ অক্টোবর, ২০২৫

নামাজই ইসলামি ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ, পবিত্রতা ও খালেস নিয়তই এর প্রাণ

মিডিয়া মিহির: ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.আ.)-এর পবিত্র মাজার শরীফে আয়োজিত এক ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সভায় বক্তা হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মোহাম্মদ মাহদী মানদেগারি বলেছেন, আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তিনি মুমিনদের বলেন, তারা যেন হারাম দৃষ্টিপাত থেকে বিরত থাকে; কারণ অপবিত্র দৃষ্টি মানুষের হৃদয়কে অসুস্থ করে তোলে।

যাদের আমরা পৃথিবীতে ক্ষমতা দিই, তারা নামাজ কায়েম করে”

বক্তা তাঁর বক্তব্যে পবিত্র কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেন— «الَّذِينَ إِن مَكَّنّاهُمْ فِي الأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلاةَ» অর্থাৎ, “যাদের আমরা পৃথিবীতে ক্ষমতা দিই, তারা নামাজ কায়েম করে।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, নামাজই ইসলামি ব্যবস্থার সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব ও ফরজ ইবাদত; এটি ধর্মীয় তাঁবুর মূল স্তম্ভস্বরূপ।

হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি বলেন, “প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রদেশে নামাজ প্রতিষ্ঠা বিষয়ক জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তাই উপযুক্ত হবে যদি আহলে বাইত (আ.)-এর এই বরকতময় হারামে প্রতিবছর নামাজ বিষয়ক একটি বিশেষ সভা বা অধিবেশন আয়োজন করা হয়, যাতে এই মহান ফরজ ইবাদত—যা সমাজের নৈতিকতা, আত্মিক বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্যের মূলভিত্তি—আরও অধিক মনোযোগ ও গুরুত্ব লাভ করে।”

নিজেদের জীবনকে নামাজে রূপান্তর করো”

মাজার শরীফের খতিব আমিরুল মুমিনিন ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “নিজেদের জীবনকে নামাজে রূপান্তর করো।”

তিনি বলেন, “নামাজ কেবল একটি আনুষ্ঠানিক ইবাদত নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাব্যবস্থা, যা মানুষকে সামগ্রিকভাবে গড়ে তোলে। আমরা যদি নামাজকে গভীরভাবে বুঝতে পারি, তবে আমাদের ধর্ম, দুনিয়া ও আখিরাত—সবই সঠিকভাবে পরিচালিত হবে।”

নামাজের পাঁচটি শিক্ষামূলক নীতি

১️. পবিত্রতা (তাহারাত): হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি বলেন, “পবিত্রতা ছাড়া কোনো নামাজ কবুল হয় না। আল্লাহ তাআলা পবিত্রতার উপকরণ হিসেবে পানি ও মাটিকে নির্ধারণ করেছেন, যা ওজু, গোসল ও তায়াম্মুমে ব্যবহৃত হয়। তবে এর গভীরতর অর্থ হলো—আমাদের জীবনও যেন অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকে। আমরা যা দেখি, যা শুনি, যা খাই, যা বলি—সবকিছুতেই পবিত্রতা থাকা জরুরি।”

তিনি সূরা নূরের আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “আল্লাহ নবী করিম (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তিনি মুমিনদের বলেন, তারা যেন হারাম দৃষ্টিপাত থেকে নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে; কারণ অপবিত্র দৃষ্টি হৃদয়কে অসুস্থ করে দেয়। যেমন অপবিত্র খাদ্য দেহে শারীরিক প্রভাব ফেলে, তেমনি হারাম দৃশ্য দেখা বা নিষিদ্ধ বিষয় শোনা আত্মায় গভীর প্রভাব ফেলে এবং কখনও কখনও মানুষকে বছরের পর বছর আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।”

তিনি আরও বলেন, “জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পবিত্রতার নীতি বজায় রাখা অপরিহার্য। বন্ধুত্ব, অতিথি আপ্যায়ন, লেনদেন ও সামাজিক সম্পর্ক—সবক্ষেত্রেই পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। কারণ, একটি অপবিত্র বন্ধুত্ব বা দূষিত সম্পর্ক মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিচ্যুত করতে পারে। ধন্য তারা, যারা শহীদের মতো পবিত্র মৃত্যুবরণ করেছেন।”

২️. খালেস নিয়ত: বক্তা নামাজের দ্বিতীয় শিক্ষামূলক নীতি হিসেবে নিয়তের বিশুদ্ধতার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “নামাজ হতে হবে قُربَةً إلی الله — শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যের উদ্দেশ্যে। রিয়া, খ্যাতি বা পার্থিব স্বার্থের জন্য নয়। যদি নামাজ মানুষের সন্তুষ্টি বা বাহ্যিক প্রশংসার জন্য হয়, তবে সেটি নামাজ নয়।”

তিনি তাঁর শিক্ষক আয়াতুল্লাহ কাজেম হায়েরির স্মৃতিচারণা করে বলেন, “আয়াতুল্লাহ হায়েরি প্রায়ই বলতেন, শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য দুই রাকাত খাঁটি নামাজ আদায় করা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। বহু আলেম ও আরিফগণ বলেছেন—যদি কেউ জীবনে অন্তত দুই রাকাত খালেস নামাজ পড়ে, সে জান্নাতের অধিকারী হয়ে যায়।”

হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি বলেন, “নামাজ আমাদের শেখায়, আমাদের প্রতিটি কাজই যেন আল্লাহর জন্য হয়—কথা বলা, নীরব থাকা, কাজ করা, শিক্ষা গ্রহণ, উপহার দেওয়া, এমনকি ভোট দেওয়া পর্যন্ত। যখন নিয়তগুলো আল্লাহমুখী হয়ে যায়, তখন সমাজ একটি নামাজপড়ুয়া, তাকওয়াপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজে পরিণত হয়।”

৩️. কিবলামুখিতা: তৃতীয় শিক্ষামূলক নীতি হিসেবে তিনি বলেন, “নামাজ শেখায় যে জীবনের সকল দিক ও কর্মকাণ্ড যেন কিবলার দিকে—অর্থাৎ আল্লাহর দিকে—নির্দেশিত থাকে। আমাদের প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্ত এমন হওয়া উচিত, যা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে, দূরে নয়। বিয়ে, কাজ, সন্তান জন্মদান কিংবা বিনোদন—যদি তা মানুষকে আল্লাহর স্মরণে উদ্বুদ্ধ করে, তবে সেটিই আল্লাহমুখী ও ইবাদতমূলক কাজ।”

তিনি যোগ করেন, “যখন আমরা দেখি প্রতিরোধের ময়দানে ইসলামি প্রতিরোধ ফ্রন্ট বা মুকাওয়ামা শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করছে, তখন আমাদের মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হওয়া উচিত ‘আল্লাহু আকবার’। এও এক ধরণের নামাজ—একটি ‘আচরণগত নামাজ’, যা আমাদের কর্মে, নীতিতে ও অবস্থানে প্রকাশ পায়।”

৪️. আদব শিষ্টাচার: চতুর্থ নীতি হিসেবে বক্তা আদব রক্ষা-র গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “যেহেতু নামাজের আদব ও শিষ্টাচার আছে, তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেও আদব থাকা উচিত—খাওয়া, পরা, বিবাহ, অতিথি আপ্যায়ন—সবক্ষেত্রেই।”

তিনি কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেন: فَسْئَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لا تَعْلَمُونَ অর্থাৎ, ‘তোমরা যদি না জানো, তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো।’

“এর মানে,” তিনি ব্যাখ্যা করেন, “জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সঠিক পদ্ধতি, আদব ও আচরণ জানতে হবে আহলে ইলম ও আলেমদের কাছ থেকে।”

৫️. ইমামত নেতৃত্ব: সবশেষে হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি বলেন, “সর্বোত্তম নামাজ সেই নামাজ, যার ইমাম আছে।”

তিনি কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেন— یَوْمَ نَدْعُوا كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ  “যেদিন আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের ইমামের নামে আহ্বান করব।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “যেমন নামাজ ইমাম ছাড়া পূর্ণতা পায় না, তেমনি জীবনও একটি ইমাম বা নেতৃত্ব ছাড়া পরিপূর্ণ হতে পারে না। জীবনেরও একটি কেন্দ্র, দিকনির্দেশনা ও অনুসরণযোগ্য নেতৃত্ব থাকা জরুরি। যখন জীবনের ইমাম আল্লাহনির্দেশিত হয়, তখন নামাজ যেমন কবুল হয়, জীবনও তেমনি আল্লাহমুখী ও অর্থবহ হয়ে ওঠে।”

বক্তার মতে, নামাজ শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব নয়; এটি এক আধ্যাত্মিক বিদ্যালয়, যা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্যের পথে পরিচালিত করে এবং সমাজকে নৈতিকতা, শুদ্ধতা ও ন্যায়বোধে সমৃদ্ধ করে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button