সূরা আর-রাহমানের আলোকে একটি ভুল ধারণার সংশোধন: জাহান্নাম—আনন্দের নয়, যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৮ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: সূরা আর-রাহমানে আল্লাহ জাহান্নামের বর্ণনা দিয়েছেন অগ্নিশিখা ও ফুটন্ত পানির মাধ্যমে, যা স্পষ্টতই ভয়াবহ শাস্তির প্রতীক। একই সঙ্গে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে: তোমরা তোমাদের প্রভুর কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে? এই পুনরাবৃত্ত প্রশ্নটি কিছু মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে, যেন জাহান্নামও আল্লাহর একটি ‘নিয়ামত’ বা উপকার। কিন্তু সূরা রাহমানের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, জাহান্নামের উল্লেখ কোনোভাবেই সুখকর বা কল্যাণকর নয়। বরং এটি একটি সতর্কবার্তা—আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রকাশ, যা অন্যায়কারীদের জন্য কঠিন শাস্তির প্রতীক। এই আয়াতগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহর নিয়ামত শুধু তাঁর রহমত ও অনুগ্রহে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁর ন্যায়বিচারও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা মানবজাতিকে সঠিক পথে চলার জন্য সতর্ক করে
সাঈদ শিরির মূল বক্তব্য
১. আল্লাহর নিদর্শনের ব্যাপকতা: সূরা আর-রাহমানের আলোকে একটি ভাবনার সংশোধন:
আয়াতে ব্যবহৃত «آلاء» শব্দটি শুধু আনন্দদায়ক বা সুখকর বিষয়ের জন্য নয়। সূরা আর-রাহমানের প্রেক্ষাপটে এটি আল্লাহর সকল গুণ ও কার্যকলাপের প্রতিফলন—যার মধ্যে রয়েছে তাঁর করুণা, ন্যায়বিচার এবং সতর্কবার্তা। তাই জাহান্নামের কঠিন শাস্তির বর্ণনার সঙ্গে এই শব্দের ব্যবহারকে শুধুমাত্র “নিয়ামত” বা “উপকার” হিসেবে ব্যাখ্যা করা সঠিক নয়। আসলে, এই শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের তাঁর পূর্ণতাকে চিনতে শেখান—যেখানে অনুগ্রহ যেমন আছে, তেমনি আছে ন্যায়বিচারের কঠোরতা। জাহান্নামের উল্লেখ এখানে একটি সতর্কতা, যা মানুষকে সঠিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। এটি কোনো সুখকর বা কল্যাণকর বাস্তবতা নয়, বরং আল্লাহর ন্যায়বিচারের একটি গম্ভীর প্রকাশ
২. জাহান্নামের বর্ণনা ও সতর্কবার্তা:
গুনাহগাররা জাহান্নামে অগ্নি ও সিক্ত জলের মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে চলাচল করবে এবং ভ্রাম্যমাণ থাকবে। এটি কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়, বরং শাস্তি এবং সতর্কবার্তা। এই বর্ণনা মূলত গুনাহীদের জন্য ন্যায়বিচারের প্রকাশ।
৩. আল্লাহর করুণা ও জাহান্নাম:
যদি কেউ জাহান্নামকে নেয়মাত “نعمت” বা উপকার মনে করে, তাহলে আল্লাহর করুণা বিপরীত অর্থে ধরা হবে। কারণ আল্লাহর করুণা মানে মানুষের মঙ্গল এবং কল্যাণ; আর শাস্তি বা কষ্ট মানে হলো নেকমাত نقمت। জাহান্নামের অভিজ্ঞতা গুনাহীদের জন্য শাস্তি, যা আল্লাহর ন্যায় এবং কখনও কখনও কঠোর শিক্ষা প্রদর্শন করে, কিন্তু এটি করুণা নয়।
৪. আয়াতের পুনরাবৃত্তি এবং শিক্ষা:
«فَبِأَیِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ» আয়াতটি জাহান্নামের বর্ণনার পর আসে। এটি দর্শকের জন্য সতর্কবার্তা, কোনো সুখকর নিদর্শন নয়। কোরআনে দেখা যায়—সুখকর নিদর্শন ও শাস্তি পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়, যাতে মানুষ আল্লাহর করুণার সুযোগ গ্রহণ করে এবং শাস্তি থেকে সতর্ক থাকে।
৫.ইমামদের ব্যাখ্যা: সূরা আর-রাহমানের আয়াতের গভীর তাৎপর্য
রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, সূরা আর-রাহমানের আয়াতে «فَبِأَیِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ» — এখানে “آلاء” শব্দটি শুধু সাধারণ নিয়ামত নয়, বরং নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর প্রতি ইঙ্গিত করে। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত পথপ্রদর্শক ও হিদায়তের মূল প্রতীক। যারা তাঁদের অগ্রাহ্য করেছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নির্দেশনা ও ন্যায়বিচারের প্রকাশকে অস্বীকার করেছেন। এই অস্বীকার ও অবহেলা তাদেরকে চিরস্থায়ী শাস্তির দিকে নিয়ে যায়, যার পরিণতি হলো জাহান্নামের কঠিন অভিজ্ঞতা।
এই ব্যাখ্যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহর “آلاء” শুধু বস্তুগত উপকার নয়, বরং তাঁর পক্ষ থেকে পাঠানো পথপ্রদর্শকদের গ্রহণ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত—যার অস্বীকৃতি চরম পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
উপসংহার
সূরা আর-রাহমান আমাদের স্পষ্টভাবে শিক্ষা দেয় যে, জাহান্নাম কখনোই “নিয়ামত” বা উপকার নয়। এটি আল্লাহর সতর্কবার্তা, ন্যায়বিচারের প্রতিফলন এবং পাপীদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি। আল্লাহর নিদর্শন, তাঁর করুণা এবং প্রেরিত পথপ্রদর্শকদের অস্বীকার—এই তিনটি উপাদানই জাহান্নামের শাস্তিকে অনিবার্য করে তোলে। জাহান্নামের বর্ণনা এবং «آلاء» শব্দের ব্যবহার সূরাটিতে এসেছে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে—যাতে তারা আল্লাহর ন্যায়বিচার ও করুণার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করে শাস্তি থেকে রক্ষা পায়।



