বিশ্বজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসসংবাদ বিশ্লেষণস্বাস্থ্য পরামর্শ

সন্তান যদি অশ্লীল ভিডিও দেখে—অভিভাবকের করণীয় কী?

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৫ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: শিশুপালনের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পদ্ধতিগত এবং বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ তদারকি। যদি কোনো শিশু ভুলবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অশ্লীল বা অনুচিত দৃশ্য দেখে ফেলে, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ হবে শিশুকে সেই ঘটনার স্মৃতির উৎস থেকে দূরে রাখা এবং বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ না করা। এই নীতি মেনে চললে শিশুর মানসিক ও আবেগিক ক্ষতি কমে, এবং তার মস্তিষ্ক প্রাকৃতিকভাবে সেই স্মৃতিকে ধীরে ধীরে ভুলে যেতে সাহায্য করে।

ঘটনা ও অভিভাবকের প্রশ্ন

একজন অভিভাবক প্রশ্ন করেছেন— “আমার পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে আছে, যার প্রতি আমি অত্যন্ত সংবেদনশীল। অবশ্য, সব পিতামাতাই সন্তানের প্রতি যত্নশীল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এক রাতে যখন আমরা খুব ব্যস্ত ছিলাম, আমার ছেলে এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে অশ্লীল ভিডিও দেখেছে, যার সঙ্গে আমরা কখনও ভাবতেও পারিনি। এখন তার মনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে এবং আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে এই বিষয়টি তার মন থেকে মুছে ফেলব। অনুগ্রহ করে আমাদের দিকনির্দেশনা দিন।”

উত্তর ও বিশ্লেষণ

পরিবার ও সন্তান প্রতিপালন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন আলী রেজা তারাশিয়ুন এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আপনার কথায় এসেছে যে আপনি সন্তানের প্রতি “খুব সংবেদনশীল”।

কিন্তু শিশুপালনে দুটি বিষয়ের সঙ্গে আমাদের বিদায় নিতে হবে —
১️. উদাসীনতা (অমনোযোগিতা)
২️.  অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা।

অভিভাবক যদি বলেন, “আমি আমার সন্তানের প্রতি খুব সংবেদনশীল,” তাহলে সেটা আসলে সঠিক নয়, কারণ এটি একটি ভুল ও অপ্রযুক্ত পদ্ধতির ইঙ্গিত।

আমরা উদাসীন হতে পারি না, তবে সংবেদনশীলতার পরিবর্তে পদ্ধতিগত ও সচেতন আচরণ জরুরি। যেসব পিতামাতা অতি-সংবেদনশীল কিন্তু শিশুপালনের সঠিক পদ্ধতি জানেন না, তারা অজান্তেই নিজেদের সন্তানকে অন্ধকার গহ্বরে” ফেলে দিতে পারেন।

যদি অভিভাবকরা সংবেদনশীলতার বদলে শিক্ষাবিজ্ঞানের সঠিক নিয়ম অনুসরণ করতেন, তবে এমন ঘটনার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যেত।

শিশুপালনের মূল নীতি

একটি মৌলিক ও অপরিহার্য নীতি হলো— শিশুরা এমন কোনো স্থানে একা থাকা উচিত নয়, যেখানে অভিভাবকের উপস্থিতি নেই। বিশেষত শিক্ষণযোগ্য বা সংবেদনশীল বয়সে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এখন করণীয় কী?

এই অবস্থায় দুটি প্রধান পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:

১️. যিনি বা যে কারণে ঘটনাটি ঘটেছে, তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করা

  • শিশুর কাছে সেই ব্যক্তি বা উৎসটি “স্মৃতির প্রতীক” হিসেবে কাজ করে।
  • প্রতিবার তাকে দেখলে, সেই ভিডিওর দৃশ্য মনে পড়বে।
  • তাই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঐ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা জরুরি।

এছাড়া, শিশুকে এমন পরিবেশে রাখুন যেখানে ইতিবাচক সম্পর্ক, খেলাধুলা এবং নতুন অভিজ্ঞতা তার মনকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে পারে।

২️. বিষয়টি নিয়ে শিশুর সঙ্গে কথা বলবেন না

  • শিশুর মনকে “ভুলে যাওয়ার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া”র মাধ্যমে সুস্থ হতে দিন।
  • অধিকাংশ পিতামাতা অতি উদ্বেগের কারণে বিষয়টি বারবার স্মরণ করান, যা আসলে বিপরীত ফল দেয়।

উদাহরণস্বরূপ, এ ধরনের প্রশ্ন করবেন না:

  • “আজ ওর সঙ্গে দেখা করেছো?”
  • “আবার কিছু দেখোনি তো?”

এই পুনঃউল্লেখ শিশুর মনে স্মৃতিটিকে আরও দৃঢ় করে। শিশুর এখন প্রয়োজন শান্তি, নিরাপত্তা ও স্নেহপূর্ণ পরিবেশ, কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নয়।

যদি বিষয়টি আর আলোচনা না হয়, শিশুর মন ধীরে ধীরে অনুচিত তথ্যকে ঢেকে দেয় এবং সময়ের সঙ্গে তা প্রায় সম্পূর্ণ ভুলে যায়।

মনোবিজ্ঞান ও ধর্মীয় নির্দেশনা

শিশুর মনে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবে শক্তিশালী, বিশেষ করে ছোট বয়সে।
যেমন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “আমি শিশুদের ভালোবাসি, কারণ তারা কষ্ট বা কুৎসা মনে রাখে না।”

অতএব, যদি এই দুটি শর্ত মেনে চলা হয়  এই স্মৃতি শিশুর মনে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে:

১. অশ্লীল দৃশ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির বা উৎসের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা।

২. বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা বা পুনঃউল্লেখ না করা।

এমনকি যদি কোনোদিন শিশু আবার ঐ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে, তবুও রাগান্বিত প্রতিক্রিয়া বা শাস্তিমূলক আচরণ করা যাবে না। সময়ই এখানে সর্বোত্তম নিরাময়ক।

অভিভাবকের জন্য সার্বিক নির্দেশনা

১. শিশুরা এমন স্থানে একা থাকবে না যেখানে অভিভাবকের উপস্থিতি নেই।  এটি নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং সচেতন ও স্নেহপূর্ণ তদারকি।

২. খেলাধুলা ও বিনোদনের পরিবেশ উন্মুক্ত রাখুন।

শিশুকে এমন জায়গায় খেলতে দিন যেখানে আপনি দেখতে পাচ্ছেন, দরজা বন্ধ করা বা নির্জন কক্ষে দীর্ঘ সময় থাকা থেকে বিরত রাখুন।

৩. বিশেষ সতর্কতা চার বা পাঁচ বছর বয়সের পর থেকে জরুরি। এই বয়সে শিশু অনুকরণে আগ্রহী হয়, তাই প্রাপ্তবয়স্কদের উপস্থিতি জরুরি।

৪. তদারকি মানে অবিশ্বাস নয়। এটি দায়িত্ববোধের প্রকাশ, যা শিশুর মানসিক সুরক্ষার পূর্বশর্ত।

৫. সময়কে তার কাজ করতে দিন।  স্মৃতি নিজে নিজে মুছে যাবে, যদি অভিভাবক শান্ত ও স্থির থাকেন।

৭. মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা নিতে দ্বিধা করবেন না। যদি শিশু দীর্ঘদিন উদ্বিগ্ন বা বিভ্রান্ত থাকে, শিশুমনোবিজ্ঞানী বা পরামর্শদাতার সাহায্য নেওয়া উচিত।

শিশু যদি ভুলবশত অশ্লীল কিছু দেখে ফেলে, অভিভাবকের করণীয় হলো শান্ত থাকা, ভালোবাসা দেখানো এবং সঠিকভাবে তদারকি করা চিৎকার, দোষারোপ বা অতিরিক্ত প্রশ্ন নয়—বরং সহানুভূতি, ধৈর্য ও সময়ই হলো শিশুর মানসিক নিরাময়ের মূল চাবিকাঠি।

শেষ কথা: সঠিক পদ্ধতি, ভালোবাসা ও বুদ্ধিমত্তার সংমিশ্রণই শিশুপালনের সফলতার নিশ্চয়তা।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button