শিয়া ঐতিহ্যের রূপান্তরে হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর ভূমিকা
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৪ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: শিয়া ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হযরত ফাতেমা মাসুমা (সা.আ.)-এর জন্মকে ঘিরে একটি বিশেষ ভবিষ্যদ্বাণী ইমাম সাদিক (আ.) বহু বছর আগে ঘোষণা করেছিলেন। এই পূর্বাভাস শুধু ইমামতের গায়েবি জ্ঞানের নিদর্শন নয়, বরং প্রমাণ করে যে হযরত মাসুমা (সা.আ.) ছিলেন একটি ঐশী দায়িত্বের অধিকারিণী এবং শিয়া সভ্যতার ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা ছিল ভাগ্যনির্ধারক।
জন্মের পূর্বেই মর্যাদা ঘোষণা
হযরত মাসুমা (সা.আ.) ইমাম মূসা কাজিম (আ.)-এর কন্যা। ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর জন্মের পূর্বেই জানান যে এক কন্যা জন্ম নেবেন, যার নাম হবে “ফাতেমা” এবং তাঁর মাজার কোম শহরে আশেকদের কাবা ও শিয়াদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে।
আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতায় অতুলনীয়
যদিও মাসুম বা নির্ভুল ব্যক্তির সংখ্যা ১৪ জন, হযরত মাসুমা (সা.) তাঁদের মধ্যে না হলেও, বাস্তবে তিনি গুনাহ থেকে মুক্ত জীবনযাপন করেছেন। নৈতিক গুণাবলী, তাকওয়া, আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি বহু ইমামজাদাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
ঐশী প্রথার ধারাবাহিকতা
কুরআন কারিমে যেমন হযরত মরিয়ম (সা.আ.)-কে হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের সংবাদ দেওয়া হয়েছিল, তেমনি হযরত মাসুমা (সা.)-এর জন্মের পূর্বাভাসও তাঁর ঐশী দায়িত্ব ও শিয়া সমাজে সভ্যতাগত ভূমিকাকে নির্দেশ করে।
হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর মহিমান্বিত স্থান ও কুম শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ইমাম সাদেক (আ.) এক বর্ণনায় বলেন:
أَلَا إِنَّ حَرَمَ اللَّهِ مَکةُ وَحَرَمَ رَسُولِ اللَّهِ الْمَدِینَةُ وَحَرَمَ أَمِیرِ الْمُؤْمِنِینَ الْکوفَةُ وَحَرَمِی وَحَرَمُ وُلْدِی بَعْدِی قُمٌّ
অর্থাৎ—“জেনে রাখো, আল্লাহর পবিত্র স্থান হলো মক্কা, রাসূলুল্লাহর পবিত্র স্থান হলো মদীনা, আমিরুল মুমিনিনের পবিত্র স্থান হলো কুফা, আর আমার ও আমার সন্তানদের (আমার পর) পবিত্র স্থান হলো কোম।”
এই বক্তব্য কেবল কোম শহরের পবিত্রতার প্রতি ইঙ্গিতই নয়, বরং হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর রওজাকে এই পবিত্রতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে উল্লেখ করায় তাঁর মহৎ মর্যাদা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
অতএব, হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর জন্ম সম্পর্কে ইমাম সাদেক (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী শিয়া ইতিহাসে তাঁর উচ্চ স্থান ও কৌশলগত ভূমিকার সুস্পষ্ট নিদর্শন। এ ধরনের মর্যাদা সব ইমামজাদাদের জন্য নয়, কেবল কয়েকজনের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, যা তাঁকে এক অনন্য ও ব্যতিক্রমী অবস্থানে স্থাপন করে।
হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর হিজরত: ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক পদক্ষেপ
হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর কোমে হিজরত শুধুমাত্র তাঁর ভাই ইমাম রেজা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই নয়, বরং এর গভীর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও রয়েছে। সাধারণত মদিনা থেকে খোরাসানগামী পথ কোম হয়ে যেত না; তবে অসুস্থতার কারণে এবং কোমে শিয়াদের উপস্থিতির খবর জানার কারণে তিনি এখানে আগমন করেন। এই সিদ্ধান্ত তাঁর আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা ও ইরানে শিয়া মতাদর্শের প্রসারে বিশেষ মনোযোগের প্রতিফলন।
ঐতিহাসিক সূত্রে পাওয়া যায়, হযরত মাসুমা (সা.আ.) অল্প কিছুদিন কোমে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর এখানেই সমাধিস্থ করা হয়। পরবর্তীকালে এই সমাধি কোম শহরের গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। ফলে ইসলাম আগমনের প্রাথমিক সময় থেকেই কোম শিয়াদের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হয় এবং কখনো অন্য কোনো মতাদর্শ সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
কুরআন কারিমে বলা হয়েছে: «وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِیعًا وَلَا تَفَرَّقُوا» (আল-ইমরান: ১০৩) অর্থাৎ—“তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না। এই আয়াত কোম শহরে শিয়া পরিচয় ও ঐক্যের প্রতিফলনকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
সাফাভি আমলের পূর্বে ইরানে সুন্নি মত ছিল রাষ্ট্রীয় ধর্ম। কিন্তু সাফাভিদের উত্থানের পর শিয়াবাদ প্রধান মতাদর্শে পরিণত হয়। যদিও তার আগেই কোম একটি শিয়া-প্রধান শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর উপস্থিতি এবং তাঁর প্রভাব এই পরিচয়কে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক স্থান
হযরত মাসুমা (সা.আ.) শুধু আধ্যাত্মিক মর্যাদার অধিকারিণী নন, বরং ইতিহাস জুড়ে মুসলিম নারীদের জন্য নৈতিকতা, জ্ঞান, তাকওয়া ও ধর্মনিষ্ঠার আদর্শ। তাঁর জীবনযাত্রা ও নিষ্পাপ চরিত্র তাঁকে ইমামদের ন্যায় অনুকরণীয় করে তুলেছে।
হাদিসে বলা হয়েছে: «اِنَّ فَضْلَ الْعُلَمَاءِ عَلَی الْعَابِدِ کَمَفْضَلِ الْقَمَرِ عَلَی السَّمَاءِ»
অর্থাৎ—“আলেমদের মর্যাদা এবাদতকারীদের উপর এমনই, যেমন আকাশে চাঁদের মর্যাদা। এই বক্তব্য তাঁর জ্ঞান ও গুণাবলীর প্রতিও ইঙ্গিত করে।
হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর আধ্যাত্মিক উপস্থিতিই কোমকে শিয়াবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বানিয়েছে। তাঁর জীবন ও উত্তরাধিকার কেবল শিয়াদের ধর্মীয় পরিচয়ই নয়, বরং তাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিকাশেও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
উপসংহার
হযরত মাসুমা (সা.আ.) শুধু একজন ইমামজাদা নন; তিনি ছিলেন অনন্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, যিনি কোমকে শিয়াদের হৃদয়কেন্দ্র ও ইরানের ধর্মীয় পরিচয়ের মূলভিত্তি করে তুলেছেন। তাঁর হিজরত ও উপস্থিতি ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে এবং আজও তিনি মুসলিম নারীদের ও সমগ্র শিয়া সমাজের জন্য প্রেরণার বাতিঘর।



