আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর দৃষ্টিতে শহীদ হাসান নাসরুল্লাহ: ‘প্রিয় ভাই’ থেকে লেবাননের ‘অমূল্য রত্ন’
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী গত তিন দশকে শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে নিয়ে যেসব বিশেষণ ও বর্ণনা ব্যবহার করেছেন, তা তাঁর প্রতি গভীর আস্থা, ভালোবাসা এবং সম্মানকে প্রতিফলিত করে। প্রথম সাক্ষাতে তাঁকে “প্রিয় ও যোগ্য ভাই” বলে সম্বোধন করা থেকে শুরু করে জীবনের শেষ প্রান্তে “অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব” এবং শাহাদাতের পর “লেবাননের উজ্জ্বল রত্ন” আখ্যা দেওয়া—সবই প্রমাণ করে যে হাসান নাসরুল্লাহ শুধু হিজবুল্লাহর নেতা নন, বরং গোটা উম্মাহর জন্য এক অমূল্য সম্পদ এবং বিশ্ব-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক আদর্শিক ও বাস্তবিক সংগ্রামের প্রতীক ছিলেন।
রাহবারের আস্থা ও প্রথম সাক্ষাৎ
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহর মহাসচিব নিযুক্ত হওয়ার মাত্র একদিন পর (১৩ এসফন্দ ১৩৭০) রাহবারে ইনকিলাবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে সময় রাহবার বলেন: “এই দায়িত্ব আজ আপনার কাঁধে, আমাদের প্রিয় ভাই সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ… আমরা সর্বদা আপনাকে হৃদয় থেকে ভালোবেসেছি এবং যোগ্য মনে করেছি। আল্লাহর কাছে এই শুভ নির্বাচনের জন্য শুকরিয়া আদায় করছি।”

এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট ছিল যে রাহবার নাসরুল্লাহর যোগ্যতা ও নেতৃত্বের ক্ষমতাকে প্রথম থেকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং তাঁকে শহীদ সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভীর প্রকৃত উত্তরসূরি হিসেবে দেখেছিলেন।
বিজয়ের স্থপতি
হিজবুল্লাহ নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে এমন সব ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করে যা রাহবারের ভাষণে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দক্ষিণ লেবানন মুক্তির পর (তীর ১৩৭৯) তিনি হিজবুল্লাহকে “একটি ঐশী সৃষ্টি” বলে আখ্যায়িত করেন, যা একসময় অপরাজেয় বলে বিবেচিত শত্রুকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল।

রাহবার আরও উল্লেখ করেছিলেন যে, নাসরুল্লাহর প্রভাব সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিল। ২০০০ সালের মে মাসে তিনি বলেন যে ফিলিস্তিনি যুবকেরা নাসরুল্লাহর ছবি বহন করছে, মসজিদুল আকসার গম্বুজে হিজবুল্লাহর পতাকা ওড়াচ্ছে—যা প্রমাণ করে তিনি এক আঞ্চলিক নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
৩৩ দিনের যুদ্ধ ও রাহবারের শ্রদ্ধা
২০০৬ সালের ৩৩ দিনের যুদ্ধে নাসরুল্লাহর নেতৃত্ব ছিল শত্রুর জন্য দুঃস্বপ্ন। কানায় ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের পর রাহবার এক বিশেষ বার্তায় হিজবুল্লাহকে “উম্মাহর সম্মুখসারির রক্ষক” হিসেবে উল্লেখ করেন এবং নাসরুল্লাহকে “আরব বিশ্বের সাহসী ও ঈমানদার নেতা” বলে স্যালুট জানান।
যুদ্ধশেষে তিনি নাসরুল্লাহর উদ্দেশে লিখেন: “আপনি যে অদম্য জিহাদ ও সংগ্রামের মাধ্যমে উম্মাহকে উপহার দিয়েছেন, তা আমার ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।”
এছাড়াও তিনি নাসরুল্লাহকে “ইসলামি বিশ্বের এক ব্যতিক্রমী মুখ” আখ্যা দেন।
মুকাওয়ামার (প্রতিরোধ অক্ষ) স্তম্ভ
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নাসরুল্লাহ ক্রমেই প্রতিরোধ অক্ষের অন্যতম প্রধান স্তম্ভে পরিণত হন। রাহবারের মতে, ইরান ও হিজবুল্লাহর কৌশলগত সম্পর্ক অঞ্চলীয় সমীকরণে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। ২০১৬ সালে শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাতে রাহবার বলেন: “যারা হিজবুল্লাহ বা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে, তারা বোঝে না নাসরুল্লাহ কী, হিজবুল্লাহ কী, এবং তাদের ইরানের সাথে সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”

২০২৪ সালের জুনে লেবাননের সংসদ-স্পিকারের সাথে সাক্ষাতে রাহবার ঘোষণা করেন: “ইরানের সাথে লেবানন ও সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহর সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং আত্মীয়তা ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক।”
শাহাদাত ও “সাইয়্যেদুল মুকাওয়ামা”-র উত্তরাধিকার
১৪০৩ সালের ৫ মেহর সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ শহীদ হন। রাহবারের শোকবার্তা ছিল একাধারে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা: “শাহাদাত ছিল বহু বছরের সংগ্রামের পর আপনার প্রাপ্য পুরস্কার। আপনি যে ভিত্তি স্থাপন করেছেন, তা আপনার রক্তে আরও দৃঢ় হবে। নাসরুল্লাহ শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক পথ, এক মক্তব—এবং সেই পথ চলতে থাকবে।”

১২ মেহর তেহরানের জুমা খুতবায় রাহবার নাসরুল্লাহকে “আমার ভাই, আমার গর্ব, ইসলামী বিশ্বের প্রিয় মুখ ও লেবাননের উজ্জ্বল রত্ন” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, নাসরুল্লাহ এখন দেহগতভাবে আমাদের মাঝে না থাকলেও তাঁর কণ্ঠস্বর ও পথচলা চিরকাল বেঁচে থাকবে।
এক অমর মক্তব
আজ “সাইয়্যেদুল মুকাওয়ামা”-র মক্তব প্রতিরোধের এক উড়ন্ত পতাকায় রূপ নিয়েছে, যা দুনিয়াজুড়ে নিপীড়িত মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করছে। তাঁর রক্ত বৃথা যাবে না—বরং তাঁর রক্তেই গড়ে উঠবে নতুন প্রজন্মের সংগ্রামী যোদ্ধারা। ইনশাআল্লাহ, তাদের হাতেই এই প্রতিরোধ চূড়ান্ত বিজয়ে পৌঁছাবে।



