পবিত্র ও সত্যিকারের প্রেমের গুণাবলি
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ভূমিকা: সত্যিকারের, পবিত্র প্রেমে মানুষের আত্মা এক অসাধারণ শুদ্ধতা ও আলো পায়। সে সমস্ত কিছু ভুলে যায়, শুধুমাত্র তার প্রিয়জনের প্রতি মনোনিবেশ করে, যে প্রিয়জন হলো পরম পরিপূর্ণতার প্রকাশ। এমন প্রেমী সব কষ্ট ও বিপদকে সহ্য করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, যেন তা তার প্রিয়জনের সঙ্গে মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। মরুভূমিতে কাবা দেখার আগ্রহে যখন সে পায় রাখে, তখন তিক্ত সমালোচনা বা ছোটখাটো প্রতিকূলতা তার হৃদয়ে স্থান পায় না।
যেমনটি এক হাদিসে কুদসী এসেছে:
إِذَا كَانَ الْغَالِبُ عَلَى الْعَبْدِ الْإِشْتِغَالَ بِي جَعَلْتُ بُغْيَتَهُ وَ لَذَّتَهُ فِي ذِكْري، فَإِذَا جَعَلْتُ بُغْيَتَهُ وَ لَذَّتَهُ فِي ذِكْرِي، عَشِقَنِي وَ عَشِقْتُهُ، فَإِذَا عَشِقَنِي رَفَعْتُ الْحِجَابَ فِيمَا بَيْنِي وَ بَيْنَهُ
(যখন একজন দাস আমার প্রতি মনোযোগী হয়, আমি তার আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দকে আমার স্মরণে স্থাপন করি। যখন সে আমার স্মরণে তার আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ স্থাপন করে, সে আমাকে ভালোবাসে এবং আমি তাকে ভালোবাসি। আর যখন সে আমাকে ভালোবাসে, আমি আমার এবং তার মধ্যে থাকা প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করি, যাতে সে আমাকে দেখা ও উপলব্ধি করতে পারে।)
আল্লাহর, ওলিরা ও মহান মূল্যবোধের প্রতি প্রেম
আল্লাহ ও ওলিয়াল্লাহর প্রতি প্রেম, উচ্চ মূল্যবোধে অনুরাগ, অর্থাৎ প্রগাঢ় ও জ্বলন্ত ভালোবাসা, সবসময় ছিল পবিত্রদের, আত্মত্যাগী শহীদদের, অন্তরপ্রাণি দীক্ষিত বেদান্তজ্ঞদের এবং মহান জ্ঞানী পণ্ডিতদের পথ প্রদর্শক। সংক্ষেপে, প্রেম ছাড়া জীবন ও আত্মিক পরিপূর্ণতার পথ পাড়ি দেয়া যায় না।
এমন প্রেমের উদাহরণগুলো আমরা দেখতে পাই:
১.আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর রাতের প্রার্থনা
২.সকালবেলার প্রার্থনা “দোয়া ই সাবাহ”
৩.দোয়া কুমাইলের প্রতিটি অনুচ্ছেদ
৪.মরুভূমির “দোয়ায়ে আরাফা”-এর প্রার্থনা
৫.ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর ১৫টি মুনাজাত এবং সমগ্র “সহীফা সাজ্জাদিয়া”
৬.মহদীর অনুসারীদের প্রেমময় প্রার্থনা “দোয়া নুদবা”
এসবই পবিত্র প্রেমের অমূল্য নিদর্শন।
প্রেমের নামে ভুল ধারণা
কিছু পণ্ডিতরা ‘প্রেম’ শব্দে নেতিবাচক সংবেদনশীলতা প্রকাশ করেন। এর কারণ হলো তারা অসৎ, ইন্দ্রিয়সিক্ত বা পাপময় প্রেম দেখেছেন। কিন্তু পবিত্র প্রেম হলো আল্লাহ ও মানবিক উচ্চ মূল্যবোধের প্রতি অগ্রসর হওয়ার সর্বশক্তিশালী প্রেরণা।
কিছু লোক ভাবেন যে, ইমাম ও নবীর বাণীতে ‘প্রেম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়নি, যা সম্পূর্ণ ভুল। নবী ও ইমামদের হাদিসগুলোতে প্রেমের ব্যবহার স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, মরহুম কোলিনী একটি হাদিসে বর্ণনা করেছেন যে নবী (সা.) বলেছেন:
«أَفْضَلُ النَّاسِ مَن عَشِقَ الْعِبَادَةَ فَعَانَقَهَا، وَأَحَبَّهَا بِقَلْبِهِ، وَبَاشَرَهَا بِجَسَدِهِ وَتَفَرَّغَ لَهَا»
(সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হলো যে ব্যক্তি ইবাদতের প্রেমে আবদ্ধ হয়; সে তা হৃদয়ে ভালোবাসে, শরীর দিয়ে অনুশীলন করে এবং সম্পূর্ণ মন দিয়ে তা পালন করে।)
একইভাবে অন্য হাদিসে বলা হয়েছে:
«إِنّ الْجَنَّةَ لَاَعْشَقُ لِسَلْمَانَ مِنْ سَلْمَانَ لِلْجَنَّةِ»
(যতটুকু সালমান (রা.) জান্নাতকে ভালোবাসে, তার চেয়ে বেশি জান্নাত সালমানকে ভালোবাসে।)
আল্লাহর প্রতি প্রেম ও সাবধানতা
মরহুম আল্লামা মাজলিসি এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন:
প্রেম হলো অতিরিক্ত ভালোবাসার মানে। কখনও মানুষ মনে করে এটি কেবল তুচ্ছ বা অবাস্তব বিষয়ের জন্য প্রযোজ্য, এবং আল্লাহ ও তাঁর সম্পর্কিত বিষয়ের জন্য ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু এই হাদিস দেখায়, তা সত্য নয়। যদিও সাবধানতা অবলম্বন করে আমরা ‘প্রেমী’ বা ‘প্রিয়তম’ শব্দগুলো সরাসরি আল্লাহর জন্য ব্যবহার না করি, কারণ আল্লাহর নামসমূহ ইরশাদমুলক (তওকিফি)।
উপসংহার
পবিত্র ও সত্যিকারের প্রেম মানুষের আত্মাকে আলোকিত করে, সমস্ত নীচ জীবনাচার্য ও হিংসার থেকে উত্তরণ ঘটায়। এটি আল্লাহর নিকট ও মানবিক উচ্চ মূল্যবোধের প্রতি অগ্রগামী পথপ্রদর্শক। নবী ও ইমামদের বাণীতে প্রেমের স্বীকৃতি এই শক্তিশালী প্রেরণার প্রতি আলোকপাত করে।
পাদটীকা:
১. কানজুল উম্মাল ফি সুন্নুল আ-কওল ওয়াল আ-ফাআল, মুতাক্কি হিন্দি, আলাউদ্দিন আলি ইবনে হুসামুদ্দিন, সম্পাদনা: বকরী হিয়ানি, সাফওয়াতুস সাক্কা, দারু রিসালা, বেইরুত, ১৪০১ হিজরি / ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ, পঞ্চম সংস্করণ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৫৩, হাদিস ১৮৭২।
২. আল-কাফী, কুলাইনী, মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইসহাক, সম্পাদনা/সংশোধন: গফফারি আলী আকবার, আখুন্দী মুহাম্মদ, দারুল কুতুবুল ইসলামিয়া, তেহরান, ১৪০৭ হিজরি, চতুর্থ সংস্করণ, (ইসলামি সংস্করণ), খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৩, (বাবয়ে ইবাদত ।
৩. রওদাতুল ওয়াআযিন ও বাসিরাতুল মুতাআযিজিন, ফাতাল নিশাবুরি, মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ, প্রকাশনা: রিযা, কুম, ১৩৭৫ শামসী, প্রথম সংস্করণ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৮২।
৪. বিহারুল আনওয়ার, মাজলিসী, মুহাম্মাদ বাকার ইবনে মুহাম্মাদ তাকী, সম্পাদনা/সংশোধন: একাধিক গবেষক, দারু ইহইয়া আত-তিরাসুল আরবি, বেইরুত, ১৪০৩ হিজরি, দ্বিতীয় সংস্করণ, খণ্ড ৬৭, পৃষ্ঠা ২৫৩, বাবে ইবাদত।
৫. পয়ামে ইমাম আমীরুল মুমিনীন (আ.), মকারেম শিরাজী, নাসের, প্রস্তুত ও সম্পাদনা: একাধিক পণ্ডিত, দারুল কুতুবুল ইসলামিয়া, তেহরান, ১৩৮৬ শামসী, প্রথম সংস্করণ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৬৬।



