শিয়াদের দৃষ্টিতে মুসহাফে ফাতেমা (সা.আ.) কী ?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: মুসহাফে ফাতেমা (সা.আ.): শিয়া সূত্রে ব্যাখ্যা ও বিতর্ক: শিয়া সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, ফাতেমা (সা.আ.)-এর কাছে একটি বিশেষ মুসহাফ ছিল, যেখানে ভবিষ্যতের ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ ছিল। এটি শুধুমাত্র আহলে বাইত (আ.)-এর এক অমূল্য ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য হয়। তবে কিছু সুন্নি ও ওয়াহাবি প্রবর্তক এই মুসহাফকে ভুলভাবে কোরআনের সমতুল্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন, যা শিয়াদের জন্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
মুসহাফের উৎস ও মাহাত্ম্য
শিয়া সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর, জিব্রাইল (আ.) ফাতেমা (সা.আ.)-এর নিকট এই মুসহাফের সংবাদ নিয়ে আসতেন। আমীরুল মুমিনীন (আ.) তার হাতে এটি লিপিবদ্ধ করতেন। এই কারণে ফাতেমা (সা. আ.)-কে মুহাদ্দেসা বলা হয়।
আল-কাফি-তে ইমাম সাদিক (আ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, ফাতেমা (সা. আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর সাতাত্তর দিন জীবনযাপন করেন এবং পিতার অকাল মৃত্যুর কারণে গভীর শোকের মধ্যে ছিলেন। জিব্রাইল (আ.) তাদের কাছে আসতেন, ভবিষ্যতে তাদের সন্তানদের প্রতি ঘটতে যাওয়া ঘটনাগুলো জানাতেন, এবং আমীরুল মুমিনীন (আ.) তা লিপিবদ্ধ করতেন। এই লিপিবদ্ধ তথ্যই পরিচিত মুসহাফে ফাতেমা (সা.আ.) হিসেবে।
সুন্নিদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা আর ওয়াহাবিদের বিতর্কিত প্রচারণা
কিছু সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদী এই মুসহাফের শব্দটি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। তারা দাবি করেন যে, শিয়াদের একটি পৃথক কোরআন আছে, যার নাম মুসহাফে ফাতিমা, যা বর্তমান কোরআনের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মুহাম্মাদ মাল্লালাহ লিখেছেন:
শিয়াদের কাছে তিনগুণ বড় কোরআন আছে, যেখানে বর্তমান কোরআনের কোনো অক্ষর নেই। আল-কাফিতে আবু বাসির থেকে আবু আবদুল্লাহ (আ.) বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমাদের কাছে মুসহাফে ফাতেমা আছে। এটি পরে তিনি যোগ করেছেন যে, সুন্নিদের একমত যে, যে ব্যক্তি কোরআনের কোনো অংশ অস্বীকার করে, বা কোরআনে কোনো পরিবর্তন বা হ্রাস ঘটেছে বলে মনে করে, সে কাফের। এমনকি শিয়াদের এই দাবী যে, একটি কোরআন আছে যেখানে বর্তমান কোরআনের কোনো অক্ষর নেই, তা আরও গুরুতর।
সুন্নিদের দৃষ্টিকোণ
সুন্নিরা মনে করেন, মুসহাফে ফাতিমা (সা.আ.)-এর অস্তিত্ব নবী মুহাম্মাদের (সা.) খাতামুন্নুবুয়াত বা শেষ নবীর মর্যাদার সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি করে না। তবে কট্টর ওয়াহাবি শিয়া-বিরোধীরা এটিকে ব্যবহার করে দাবি করেন যে, শিয়ারা আহলে বাইতের কাছে ওহী বা জ্ঞানের প্রবাহ গ্রহণ করে, যা প্রায় নুবুওত্ব দাবি করার সমতুল্য।
মুসহাফ’ শব্দের শব্দতত্ত্ব ও ‘মুসহাফে ফাতেমা
১. ‘মুসহাফ’ শব্দের শব্দতত্ত্ব ও কুরআনের সঙ্গে এর সম্পর্ক : মুসহাফ’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো—একাধিক সাহিফা বা পৃষ্ঠা একত্রিত করে যে সংকলন প্রস্তুত করা হয়, যা দুই মলাটে বাঁধা হয়ে সংরক্ষিত থাকে। প্রাথমিক যুগে যেকোনো বই বা কিতাবকেও ‘মুসহাফ’ বলা হতো। উদাহরণস্বরূপ—ঐতিহাসিক গ্রন্থে ‘মুসাহিফুর রূম’ এর ব্যবহার পাওয়া যায়।
রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইন্তিকালের পর কুরআন শরিফ একত্রিত করার প্রক্রিয়া শুরু হলে ধীরে ধীরে ‘মুসহাফ’ শব্দটি বিশেষভাবে কুরআনের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। সুন্নি ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, কুরআনকে ‘মুসহাফ’ নামে অভিহিত করা শুরু হয় প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর এর যুগ থেকে।
তবে, এর আগে খালিদ ইবনে মাআদানসহ আরও কয়েকজন ব্যক্তির জ্ঞানলিপি ও সংকলনকেও ‘মুসহাফ’ বলা হতো। ধীরে ধীরে শব্দটি কেবল কুরআনের সঙ্গেই বিশেষায়িত হয়ে যায়।
২. ‘মুসহাফে ফাতেমা’ এবং তার প্রকৃত বিষয়বস্তু: শিয়া-বিরোধী কিছু গোষ্ঠী ইমাম সাদিক আ.-এর একটি হাদিসের অপব্যাখ্যা করে দাবি করে, শিয়াদের নাকি অন্য একটি কুরআন আছে—যাকে তারা ‘মুসহাফে ফাতেমা’ বলে। অথচ হাদিসটির প্রকৃত অর্থ হলো, এই কিতাবে কুরআনের কোনো আয়াত নেই; বরং এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গ্রন্থ, যেখানে ভবিষ্যতের সংবাদ ও ঐতিহাসিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল।
হাদিসের থেকে জানা যায়:
১. রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইন্তিকালের পর সায়্যিদা ফাতেমা সা.আ.-এর গভীর শোক প্রশমিত করতে জিবরাঈল আ. আল্লাহর আদেশে তাঁর নিকট আসতেন।
২. তিনি তাঁকে রাসূলুল্লাহ সা.-এর জান্নাতি মর্যাদার কথা জানাতেন।
৩. ভবিষ্যতে ঘটতে যাওয়া ঘটনাবলি, শাসক ও শাসনের বিবরণ দিতেন।
৪. পূর্ববর্তী নবী, মুমিন ও কাফেরদের কাহিনি তুলে ধরতেন।
অতএব, ‘মুসহাফে ফাতেমা’ কুরআনের বিকল্প কোনো গ্রন্থ নয়, বরং ভবিষ্যৎবাণী ও ঐতিহাসিক ঘটনার সমাহার।
৩. ফাতেমা সা. আ.-এর ‘মুহাদ্দেসা’ হওয়া ও খাতমে নুবুয়তের প্রশ্ন: ওহীর বিভিন্ন ধরণ আছে: নুবুয়াত, রিসালাত, ইলহাম, ইশারা, তাকদীর ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইন্তিকালের পর নুবুয়াত-ওহী বন্ধ হয়েছে, কিন্তু অন্য ধরণের যোগাযোগ অব্যাহত থাকতে পারে।
সুন্নি সূত্রেই পাওয়া যায়, উমর ইবনুল খাত্তাব ছিলেন একজন ‘মুহাদ্দেস’, অর্থাৎ ফেরেশতা তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন, যদিও তিনি নবী ছিলেন না।
যখন মরিয়ম আ.-এর মতো এক নারীর সঙ্গে ফেরেশতা যোগাযোগ করেছিলেন তাঁর পবিত্রতা ও মর্যাদার কারণে, তখন ফাতেমা সা.আ.—যিনি জান্নাতি নারীদের সর্দার—তাঁর সঙ্গে ফেরেশতার যোগাযোগ আরও বেশি যৌক্তিক। শিয়া সূত্রে ফাতেমা সা.আ.-এর ‘মুহাদ্দাসা’ হওয়াকে মরিয়ম আ.-এর অভিজ্ঞতার সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছে।
৪. ফাতেমা সা.আ.-এর সংকলিত কুরআন বনাম ‘মুসহাফে ফাতেমা:কিছু শিয়া সূত্রে উল্লেখ আছে, খলিফা উসমান কুরআন একত্র করার সময় ইমাম আলী আ.-এর কাছে ফাতেমা সা.আ.-এর সংকলিত কুরআন চান। এটি নবী সা.-এর জীবদ্দশায় তাঁর নির্দেশনায় লেখা হয়েছিল এবং প্রচলিত কুরআনের সঙ্গেই অভিন্ন ছিল।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইন্তিকালের পর যে ‘মুসহাফে ফাতেমা’ সংকলিত হয়, তা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা একটি গ্রন্থ—যেখানে ভবিষ্যতের সংবাদসমূহ ছিল। দুর্ভাগ্যবশত কিছু সালাফি ইচ্ছাকৃতভাবে এই দুইটি বিষয়কে মিশ্রিত করে বিভ্রান্তি ছড়ায়।
৫. ‘মুসহাফে ফাতেমা’র সংরক্ষণ ও বর্তমান অবস্থান:ইমাম বাকির আ.-এর হাদিস অনুযায়ী, ফাতেমা সা.আ. এই কিতাব ইমাম আলী আ.-এর হাতে তুলে দেন। এরপর এটি পর্যায়ক্রমে ইমাম হাসান আ., ইমাম হুসাইন আ. এবং অন্যান্য ইমামদের হাতে হস্তান্তরিত হতে থাকে। বর্তমানে এটি ইমাম মাহদী আ.জ.-এর নিকট সংরক্ষিত রয়েছে, যা আহলুল বায়তের এক অমূল্য ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত।
উপসংহার
মুসহাফ’ শব্দটি মূলত একটি সাধারণ সংকলন বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও সময়ের প্রবাহে এটি কুরআনের জন্য বিশেষায়িত হয়ে যায়। তবে ‘মুসহাফে ফাতেমা’ নামক গ্রন্থটির সঙ্গে কুরআনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি ছিল ভবিষ্যতের ঘটনাবলি ও আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতার মাধ্যমে প্রদত্ত সংবাদসমূহের সংকলন। আর শিয়া মুসলমানরা সর্বদাই সেই একই কুরআনকে মেনে এসেছে, যা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে প্রচলিত।
পাদটীকা
১. বাসায়িরুদ-দারাজাত, সাফফার কুম্মী, قم, ১৪০৪ হি., পৃ. ১৫৩–১৫৫।
২. ইলালুশ-শারায়ি‘, শায়খ সদূক, নাজাফ, ১৩৮৫ হি., খ. ১, পৃ. ১৮২।
৩. আল-কাফি, কুলাইনি, তেহরান, ১৪০৭ হি., খ. ১, পৃ. ২৪০–২৪১।
৪. ইহসান ইলাহী জহীর, আস-সুন্নাহ ওয়া আশ-শিয়াহ, লাহোর, ১৯৭৬, পৃ. ৮১।
৫. মুহাম্মদ মাল্লাহ, আশ-শিয়াহ ওয়া তাহরিফুল কুরআন, বৈরুত, ১৪০২ হি., পৃ. ৬৩।
৬. আল-কাফি, খ. ১, পৃ. ২৩৯।
৭. একই গ্রন্থ, পৃ. ১২১।
৮. কিয়ানি, কোদামিন রাহ, কুম, ১৩৮৫ শি., পৃ. ৫।
৯. লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর, বৈরুত, ১৪১৪ হি., খ. ৯, পৃ. ১৮৬।
১০. মাহমুদ রামইয়ার, তারিখুল কুরআন, তেহরান, ১৩৬৯ শি., পৃ. ১০।
১১. দানিশনামা-ই কুরআন ও কুরআন-পাজুহি, তেহরান, ১৩৭৭ শি., খ. ২, পৃ. ২০৬৬।
১২. মাহদাভী রাদ, পাজুহেশি দরবারে মুসহাফে ফাতেমা, তেহরান, ১৩৮৭ শি., পৃ. ২২।
১২. ইবনে আবি দাউদ, কিতাবুল মাসাহিফ, কায়রো, ১৪২৩ খ্রিঃ, পৃ. ৩০৫।
১৩. আল-কাফি, খ. ১, পৃ. ২৪০; বাসায়িরুদ-দারাজাত, পৃ. ১৭০।
১৪. বাসায়িরুদ-দারাজাত, পৃ. ১৫৬–১৫৭।
১৫. আল-কাফি, খ. ১, পৃ. ২৪০–২৪১।
১৬. তাবারী আমেলী, দালায়িলুল ইমামাহ, কুম, ১৪১৩ হি., পৃ. ১০৫–১০৬।
১৭. মাকারিম শিরাজী, পায়ামে কুরআন, তেহরান, ১৩৮৬ শি., খ. ৭, পৃ. ৩২৪।
১৮. মাজলেসি, বিহারুল আনওয়ার, বৈরুত, ১৪০৩ হি., খ. ২২, পৃ. ৫৪৫।
১৯. হক্কী বারসাওয়ী, তাফসীর রূহুল বায়ান, বৈরুত, খ. ৩, পৃ. ৪৮০।
২০. রুইয়ানী, মুসনাদুস-সাহাবাহ, বৈরুত, ১৪১৭ হি., খ. ১২, পৃ. ২৩১।
২১. ইবনে হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী, বৈরুত, ১৩৭৯ হি., খ. ৭, পৃ. ৫০।



