বিশ্ববিশেষ সংবাদসংবাদ বিশ্লেষণ

আমেরিকার সমর্থন হারাচ্ছে ইসরায়েল: গাজা যুদ্ধ পাল্টে দিচ্ছে জনমত

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আমেরিকার সমর্থন হারাচ্ছে ইসরায়েল: গাজা যুদ্ধ পাল্টে দিচ্ছে জনমত; বিশাল সামরিক সহায়তা ও তেলআবিবকে নিঃশর্ত সমর্থনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে

মিডিয়া মিহির: গাজা যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও বেসামরিক মৃত্যুর ছবি যুক্তরাষ্ট্রে জনমতের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। একসময় ইসরায়েলের জন্য আমেরিকান সমর্থন ছিল প্রায় অটল; এখন সেই সমর্থন দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে—যা ইসরায়েলের জন্য কেবল কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ নয়, বরং একটি বড় কৌশলগত সতর্কবার্তা।

মিত্রতার প্রতীক বনাম বাস্তবতা

১৪ সেপ্টেম্বর, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে জেরুজালেমের পবিত্র স্থানে নিয়ে পশ্চিম প্রাচীরের দুই হাজার বছরের পুরনো পাথর দেখানোর পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, দুই দেশের মিত্রতা “ঠিক সেই পাথরের মতোই শক্ত ও স্থায়ী।” কিন্তু দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, নেতানিয়াহুর ধারণা ভুল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় চলমান যুদ্ধ ইসরায়েলকে ক্রমেই আন্তর্জাতিক পরিসরে বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। বর্তমানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা ও ফ্রান্সের মতো মিত্ররা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণে প্রকৃত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে গেছে। ফলে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলকে এমন একঘরে অবস্থান থেকে রক্ষা করছে, যার গুরুতর কূটনৈতিক, আইনগত ও সামরিক পরিণতি হতে পারে।

সম্পর্কের ভিতরে ফাটল

নেতানিয়াহু যদিও দাবি করেন, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক “অটল,” বাস্তবে সম্পর্কের ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্প প্রশাসনকেও ক্ষুব্ধ করেছেন এবং দুই দেশের সম্পর্কের ভেতরের গভীর ফাটলকে উপেক্ষা করছেন। ডেমোক্র্যাট ভোটাররা অনেক দিন ধরেই ইসরায়েল থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন, আর এখন রিপাবলিকানদের মধ্যেও আস্থা দ্রুত কমছে। হঠাৎ করে আমেরিকান জনসমর্থন হারানো ইসরায়েলের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

জরিপে জনমতের নাটকীয় পরিবর্তন

আমেরিকার জনমত বিষয়ক সাম্প্রতিক জরিপগুলো বিস্ময়কর। ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকান সমর্থনের হার গত ২৫ বছরে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে। ২০২২ সালে ৪২ শতাংশ আমেরিকান ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ শতাংশে। ইউগভ/ইকোনমিস্টের এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেন যে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।

গত তিন বছরে ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব ২৩ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। ৫০ বছরের নিচের রিপাবলিকানদের সমর্থন এখন সমানভাবে বিভক্ত—যেখানে ২০২২ সালে ৬৩ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে ছিলেন। ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৩০ বছরের নিচের ইভানজেলিক খ্রিস্টানদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ৬৯ শতাংশ থেকে নেমে আসে মাত্র ৩৪ শতাংশে। জরিপকারীরা মনে করেন, এই পরিবর্তন এখনো বহাল রয়েছে।

প্রজন্মগত ও রাজনৈতিক বিভাজন

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আমেরিকার জনমত ইসরায়েলের জন্য শক্তিশালী স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক জরিপগুলো দেখাচ্ছে যে নেতিবাচক মনোভাব গত এক চতুর্থাংশ শতাব্দীতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই প্রবণতা বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট ভোটার ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তীব্রভাবে দৃশ্যমান। এমনকি রিপাবলিকানদের মধ্যেও—যারা ঐতিহ্যগতভাবে ইসরায়েলের শক্ত সমর্থক—দৃশ্যমানভাবে সমর্থন কমে গেছে।

এই মনোভাব পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি হলো গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও বেসামরিক হতাহতের হৃদয়বিদারক ছবি। এসব দৃশ্য আমেরিকান নাগরিকদের নৈতিক বোধ ও মানবিক বিবেককে নাড়া দিচ্ছে, বিশেষত তরুণদের। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক সহায়তা ও তেলআবিবকে নিঃশর্ত সমর্থনের যৌক্তিকতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সমতার দাবিতে সোচ্চার হওয়া এই প্রজন্ম আমেরিকার দ্বিমুখী নীতি ও পক্ষপাতমূলক অবস্থানকে কঠোর সমালোচনার মুখে ফেলেছে।

কৌশলগত সতর্কবার্তা

প্রজন্মগত ও রাজনৈতিক বিভাজন দ্রুত গভীর হচ্ছে। ডেমোক্র্যাট পার্টির ভেতরে ইসরায়েল সমর্থন ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ৫০ বছরের নিচের ভোটার, শহুরে সম্প্রদায় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমালোচনামূলক মতামত এখন প্রাধান্য পাচ্ছে। এই প্রবণতা মার্কিন রাজনীতিবিদদের বাধ্য করতে পারে সামরিক সহায়তা পুনর্বিবেচনা করতে অথবা তাতে নতুন শর্ত আরোপ করতে।

ইসরায়েলের জন্য এটি কেবল জনমতের জরিপ নয়—এটি একটি কৌশলগত সতর্কবার্তা। কেবল মার্কিন সরকারের আনুষ্ঠানিক সমর্থনের ওপর নির্ভর করা এখন আর নিরাপদ নয়। নতুন প্রজন্ম মানবাধিকারের প্রশ্নে আপসহীন। যদি তেলআবিব কেবল সামরিক শক্তিনির্ভর নীতি চালিয়ে যায়, তবে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়া এবং কংগ্রেসে লবির ক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়বে।

দ্য ইকোনমিস্ট-এর বার্তা স্পষ্ট—যদি ইসরায়েল আমেরিকার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, তবে তাকে আমেরিকান সমাজের নৈতিক ও মানবিক উদ্বেগের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। তা না হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক মূলধন ক্ষয় হয়ে যাবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমর্থনও হাতছাড়া হতে পারে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button