কুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণহাদিস

বুদ্ধি প্রকাশের নিখুঁত সীমা, বচনের সীমালঙ্ঘন বিপদের সূত্র

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির:ইমাম আলী (আ.) তাঁর নাহজুল বালাগাহর বাণীতে মানব জীবনে বুদ্ধি, সংযম ও বিবেচনার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, কথার পরিমাণ ও মান নির্ভর করে মানুষের বুদ্ধির গভীরতার উপর। কম কথা বলা, বিচক্ষণভাবে কথা বলা, এবং অযথা বাক্যবাণী এড়ানো—এই তিনটি বিষয় বুদ্ধিমানের পরিচয় বহন করে। এই বাণী শুধু ব্যক্তিগত চরিত্র গঠনের জন্যই নয়, বরং সামাজিক সম্পর্ক ও নৈতিক আচরণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে।

ইমাম আলী (আ.) নাহজুল বালাগার হিকমত ৭১-এ বুদ্ধির পূর্ণতা ও কম কথা বলার মধ্যে গভীর সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। তিনি অকেজো ও অযথা কথাবার্তা এড়ানোকে বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ মনে করেছেন।

হিকমত ৭১:
«إِذَا تَمَّ الْعَقْلُ، نَقَصَ الْکَلَامُ.»
অনুবাদ: যখন বুদ্ধি পূর্ণ হয়, তখন কথার পরিমাণ কমে যায়।

বুদ্ধির পূর্ণতা ও কম কথা বলার ব্যাখ্যা

ইমাম আলী (আ.) এই বাণীতে নীরবতা ও সংযমের গুরুত্ব স্পষ্ট করেছেন। আমাদের বলা হয়েছে, বুদ্ধিমানের মানুষ কম কথা বলে এবং সময়মতো বিবেচনামূলকভাবে কথা বলে।

১. বুদ্ধির মূল অর্থ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ:
যেমন উটের লাগাম বাঁধার জন্য ‘আকল’ ব্যবহার করা হয়, যা তাকে অযথা চলাফেরা থেকে বিরত রাখে, ঠিক তেমনিভাবে বিবেচিত ও সংযত কথাই সত্যিকারের বুদ্ধিমানের পরিচয়। অযথা কথা প্রচুর হয়, তবে বোঝাপড়াপূর্ণ কথা হয় কম। তাই বুদ্ধি মানুষকে বলে: বেশি ভাবো, কম বলো।

২. প্রয়োজনীয় কথা কম, অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি:
এজন্য বুদ্ধিমান ব্যক্তি সাধারণত নীরব থাকে। তারা বুঝে কখন কথা বলা প্রয়োজন এবং কখন নীরব থাকা উত্তম।

৩. ভাষা, পাপ ও বিপদের সূত্র:

বুদ্ধিমান ব্যক্তি জানে যে সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ পাপগুলি ভাষার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। অতএব, ক্ষতিকর পরিণতি এড়াতে কম কথা বলা বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আমরা দেখি অনেকেই ধর্মীয় বা নৈতিক বিষয়ে কথা বলেন, অথচ কথাগুলোকে নিজের কর্মের অংশ মনে করেন না। সভায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনর্থক, গীবত বা কটূক্তিপূর্ণ কথাও বলতে দ্বিধা করেন না। বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনোই নিজের উপর বিপদের বীজ বপণ করেন না।

৪. অতিভাষণের ক্ষতি:

বহু কথা বলা মানুষের শক্তি ও সময় নষ্ট করে, শত্রুতা সৃষ্টি করে এবং মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য ভাঙে। তাই বুদ্ধি ও শরীয়াত আমাদের নির্দেশ দেয় সংযমী ও নির্বাচিতভাবে কথা বলার।

প্রাসঙ্গিক হাদিস

ইমাম আলী (আ.) গুরারুল হিকামে বলেন:
«إیّاکَ وَفُضُولَ الْکَلامِ فَإنَّهُ یُظْهِرُ مِنْ عُیُوبِکَ ما بَطَنَ وَیُحَرِّکُ عَلَیْکَ مِنْ أعْدائِکَ ما سَکَنَ»
অর্থাৎ: অতিভাষণ থেকে বিরত থাক, কারণ এটি তোমার লুকানো দোষগুলো প্রকাশ করে এবং তোমার শান্ত শত্রুদের ক্রোধ জাগায়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) হাদিসে বলেন:
«إنَّ الرَّجُلَ لَیَتَحَدَّثُ بِالْحَدیثِ ما یُریدُ بِهِ سُوءًا إلاّ لِیُضْحِکَ بِهِ الْقَوْمُ یَهْوی بِهِ أبْعَدَ مِنَ السَّماءِ»
অর্থাৎ: মানুষ কখনও কখনও এমন কথা বলে যার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকে না, শুধু মানুষকে হাসাতে চায়, কিন্তু সেই কারণে সে নিজের মর্যাদা হারায়, যেমন পৃথিবী থেকে আকাশের দূরত্ব।

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন:
«مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْکُهُ مَا لاَ یَعْنِیهِ»
অর্থাৎ: ইসলামের সঠিক আচরণের চিহ্ন হলো এমন বিষয় নিয়ে কথা বলা এড়ানো, যার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

উপসংহার

ইমাম আলী (আ.) আমাদের শেখাচ্ছেন, বুদ্ধি ও সংযমের চূড়ান্ত প্রকাশ হলো কম কথা বলা। কথা যখন বিবেচনাপূর্ণ হয়, তখন সেটি কেবল শোনার মতো নয়, বরং মানুষের নৈতিক ও আত্মিক উন্নয়নের পথপ্রদর্শক হয়। অতিরিক্ত বা অযথা কথা শুধুমাত্র শক্তি ও সময় নষ্ট করে, মনোবল কমায় এবং বিপদের সূত্রপাত করে।

বুদ্ধিমান মানুষ তাই নীরবতার মাঝে শক্তি খুঁজে, এবং সময়মতো, প্রয়োজনমত এবং বিবেচিতভাবে কথা বলে। এই দিক নির্দেশনা আমাদের শেখায় যে, বুদ্ধিমানের পথে পদচারণা হয় শ্রবণ, চিন্তাভাবনা এবং বিবেচিত বক্তব্যের আলোকে বিচার করা।

পাদটীকা

১. গুরারু হেকাম, মিজানুল হিকমা অনুসারে হাদিস ১১৮৪৯, বিষয়: “অতিভাষণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ”।
২. মিজানুল হিকমা, একই বিষয়।
৩. বিহারুল আনোয়ার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১৬, হাদিস ২৮।
৪. বাণীর উৎস ও ধারাবাহিকতা:
এই প্রজ্ঞাময় উক্তিটি জাহিজ তাঁর আল-মিয়াহ আল-মুখতারিয়াহ বইতে সায়্যিদ রাজির আগে উল্লেখ করেছেন। এরপর সায়্যিদ রাজির পরে, এই বাণীকে উদ্ধৃত করেছেন—

  • ইবনে তালহা শাফি (মাতালিবুস সু’ওয়াল)
  • জমকাশারি (রবিই উল-আবরার)
  • মাইদানি (মাজমা’ আল-ইমছাল)

নাহজুল বালাগা” বইয়ে এই বাণী অন্যান্য অনুরূপ বাণীর সঙ্গে ইমাম আলীর (আ.) তাঁর পুত্র ইমাম মুজতবা (আ.)-কে দেওয়া ওছিয়াত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে আমরা উক্ত ওছিয়তের মূল পাঠে এটি সরাসরি খুঁজে পাইনি।

সূত্র: বই পাইয়ামে নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যা।

আরও পড়ুন

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button