মৃত্যু চূড়ান্ত হলে দোয়া ও মানবিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব কী?
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মৃত্যু চূড়ান্ত হলে দোয়া ও মানবিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব কী? দোয়া, তাওবা, আত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক (সিলাতু-রাহম) ও তাকওয়া আজাল মুয়াল্লাককে বিলম্বিত করতে পারে।
মিডিয়া মিহির: কুরআনে মানুষের মৃত্যু দুইভাবে বর্ণিত হয়েছে—চূড়ান্ত (আজাল মুসাম্মা) এবং শর্তসাপেক্ষ (আজাল মুয়াল্লাক)। এই বিভাজন মানবিক এখতিয়ার, দোয়া, সৎ কর্ম এবং আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার মধ্যে সমন্বয় দেখাতে বিদ্যমান।
কুরআনের বর্ণনায় দুই প্রকার মৃত্যুর ব্যাখ্যা:
১. আজাল মুসাম্মা: চূড়ান্ত মৃত্যু
‘আজাল মুসাম্মা’ হলো সেই মৃত্যু যা লোহে মহফুজে (নির্ধারিত পটভূমিতে) লেখা, যা কোনোভাবেই পরিবর্তন বা বিলম্ব করা যায় না। এটি মানুষের প্রকৃত বয়সের শেষ নির্দেশ করে।
فَإِذا جاءَ أَجَلُهُم لا یَستَأخِرونَ ساعةً وَ لا یَستَقدِمونَ
“যখন তাদের আজাল এসে পৌঁছাবে, তারা এক সেকেন্ডও পিছিয়ে যাবে না, এবং এক সেকেন্ডও এগোতে পারবে না।” [সূরা ইউনুস: ৪৯]
এটি আল্লাহর পরিপূর্ণ জ্ঞান ও কর্তৃত্ব নির্দেশ করে। পৃথিবীর কোনো শক্তিই এই চূড়ান্ত মৃত্যুকে পরিবর্তন করতে পারে না।
২. আজাল মুয়াল্লাক: শর্তসাপেক্ষ মৃত্যু
আজাল মুয়াল্লাক হলো মৃত্যু যা মানুষের কাজ, দোয়া ও নৈতিক আচরণের ওপর নির্ভরশীল। এটি ‘লুহে মাহও ও এসবাত’-এ সংরক্ষিত এবং মানুষের কাজ ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সাময়িকভাবে পরিবর্তন করা যায়।
সৎ কর্মকাণ্ডের প্রভাব: দোয়া, তাওবা, আত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক (সিলাতু-রাহম) ও তাকওয়া আজাল মুয়াল্লাককে বিলম্বিত করতে পারে।
পাপ ও ভুলের প্রভাব: খারাপ কাজ তা দ্রুত ঘটাতে পারে।
وَیَمْحُوا اللَّهُ مَا یَشَاء وَیُثْبِتُ وَعِندَهُ أُمُّ الْکِتَابِ
“আল্লাহ যা চায় মুছে দেন এবং যা চায় স্থির রাখেন। এবং তাঁর কাছে মূল পাণ্ডুলিপি আছে।” [সূরা রা‘দ: ৩৯]
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেছেন:
آنها دو اجلاند؛ اجل مشروط که خدا در آن هرچه بخواهد میکند و اجل محتوم।
“দুটি আজাল রয়েছে—একটি শর্তসাপেক্ষ (আজাল মুয়াল্লাক), যা আল্লাহ ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারেন, আর একটি চূড়ান্ত (আজাল মুসাম্মা)।” [বিহারুল আনোয়ার, খণ্ড ৭, পৃ. ৩৭৬]
৩. আজালের বিভাজনের হিকমত: মানবিক এখতিয়ার ও আল্লাহর জ্ঞান
যদি সব মৃত্যু চূড়ান্ত হতো, তাহলে মানুষের চেষ্টা, দোয়া ও সংশোধনের মানে কী হত?
যদি সব আজাল শর্তসাপেক্ষ হতো, তাহলে কিভাবে আল্লাহর চূড়ান্ত জ্ঞান ও সিদ্ধান্তের কথা বলা যেত?
ফলাফল: আল্লাহ মানুষের জন্য দোয়া, চেষ্টা ও সৎ কর্মকাণ্ডের সুযোগ রেখেছেন, একই সঙ্গে তাঁর জ্ঞান অনুযায়ী চূড়ান্ত বিচারও নিশ্চিত।
৪. দোয়া ও সৎ কর্মের প্রভাব
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন:
دعا، قضای حتمی را هم برمیگرداند
“দোয়া চূড়ান্ত বিধিকেও ফিরিয়ে দিতে পারে।” [কাফি, খণ্ড ২, পৃ. ৫৩৭]
অর্থাৎ, আজাল মুয়াল্লাক প্রভাবিত করা যায়, এবং বিরল ক্ষেত্রে আজাল মুসাম্মা ও আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তন করা সম্ভব।
৫. মৃত্যুর সময় গোপন রাখা: পরীক্ষা ও নম্রতা
কুরআন ও হাদিসে বলা হয়েছে, মানুষের আজাল মুসাম্মার সময় জানা হয় না, যাতে সে সর্বদা সতর্ক ও নম্র থাকে।
وَلا تُعْطَى النَّفْسُ إِلّا ما سَعَتْ
“মানুষকে শুধু তার চেষ্টা অনুযায়ী প্রতিদান দেওয়া হয়।” [সূরা নাজম: ৩৯]
৬. জাতি ও সমাজের আজাল
وَلِکُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ…
“প্রত্যেক জাতির জন্য একটি আজাল নির্ধারিত আছে।” [সূরা আ’রাফ: ৩৪]
এটি নির্দেশ করে যে, শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজ ও জাতিরও জীবনচক্রে আজাল প্রযোজ্য। সমাজের নৈতিক অবনতি বা অশুদ্ধতা তার ‘অজল’কে প্রভাবিত করে এবং নতুন ব্যবস্থা স্থাপিত হয়।
পরিসমাপ্তি:
১. আল্লাহ আজালকে দুই ভাগে রেখেছেন—আজাল মুসাম্মা (চূড়ান্ত) ও আজাল মুয়াল্লাক (শর্তসাপেক্ষ)।
২. মানবিক প্রচেষ্টা, দোয়া ও সৎ কর্মকাণ্ড আজাল মুয়াল্লাককে প্রভাবিত করতে পারে।
৩. এই বিভাজন মানুষের দায়িত্ব, নৈতিকতা এবং আল্লাহর জ্ঞানকে সমন্বিতভাবে প্রদর্শন করে।
৪. মৃত্যুর সময় গোপন রাখা মানুষকে সতর্ক ও নম্র রাখে।
৫. সমাজ ও জাতির জীবনেও আজাল প্রভাবশালী, যা ইতিহাস ও নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত।
সূত্র:
১. বিহারুল আনোয়ার, খণ্ড ৭, পৃ. ৩৭৬
২. কাফি, খণ্ড ২, পৃ. ৫৩৭
৩. ইসলাম কুইজিস্ট, শহীদ আভিনী