আমেরিকায় জোলানি; ১০ মিলিয়নের ওয়ারেন্টেড সন্ত্রাসী থেকে মেহমান!
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আমেরিকায় জোলানি; ১০ মিলিয়নের ওয়ারেন্টেড সন্ত্রাসী থেকে মেহমান! যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও অঙ্গীকারের এক বিরাট বৈপরীত্যের উদাহরণ।
মিডিয়া মিহির: একসময়ের ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী আবু মোহাম্মদ জোলানি এখন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে নিউইয়র্কে। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যক্তির মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছিল, গ্রেফতারের পরিবর্তে তাকে এখন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে স্বাগত জানানোর ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
মাত্র এক বছর আগে পর্যন্ত যদি হায়াত তাহরির আল-শামের নেতা জোলানি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করতেন, তবে গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি ছিল প্রবল। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তার আগের সংগঠন জাবহাত আল-নুসরার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, যাতে তার অবস্থান জানিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা যায়।
কিন্তু আজ পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জোলানি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিত। এই সফরকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ব্যবহারকারীরা এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, “যে ব্যক্তি একসময় আমেরিকানদের কারাগারে বন্দী ছিলেন, আজ তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছেন—এ যেন ইতিহাসের এক বিরাট বৈপরীত্য।”
অনেকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, জোলানি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন। ১৬ মে ২০১৩ তারিখে তার নাম ওই তালিকায় যুক্ত হয় এবং ১০ মে ২০১৭ যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান জানাতে পারলে ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। অথচ আজ, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ, তিনি নিউইয়র্কে। এক ব্যবহারকারী লিখেছেন: “যে দেশ একসময় জোলানির মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছিল, আজ সেই দেশই তাকে লাল গালিচায় স্বাগত জানাচ্ছে।”
অতীত থেকে বর্তমান: কারাগার থেকে কূটনৈতিক মঞ্চে
ব্যবহারকারীদের এই বিস্ময় বোঝার জন্য জোলানির অতীত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের ইতিহাস জানা জরুরি।
২০০৩ সালে মার্কিন আক্রমণের পর জোলানি ইরাক যান এবং কিছুদিন মসুলে অবস্থান করেন। তিনি আবু মুসাব আল-জারকাওয়ির নেতৃত্বাধীন আল-কায়েদার শাখায় যোগ দিয়ে যুদ্ধ করেন। পরে মার্কিন সেনারা তাকে গ্রেপ্তার করে আবু ঘরাইব কারাগারে পাঠায়। পরবর্তীতে তাকে বোকার ক্যাম্প এবং বাগদাদ বিমানবন্দরের ক্রোপার কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র তাকে ইরাকি সরকারের হাতে তুলে দেয় এবং তাজি কারাগারে রাখা হয়, যেখান থেকে তিনি ২০০৮ সালে মুক্তি পান।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট, তার নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন যে আমেরিকাই আসলে মধ্যপ্রাচ্যে আইএসআইএস সৃষ্টির মূল কারণ, যদিও পরে তারা এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তবে সমালোচকরা বলছেন, বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নীরবে সহায়তা করে এসেছে।
মুক্তির পর জোলানি আইএসআইএস-এ (তৎকালীন ইসলামিক স্টেট অব ইরাক) যোগ দেন, যা ২০০৬ সালের অক্টোবরে আবু বকর আল-বাগদাদি গঠন করেছিলেন। তিনি দ্রুত মসুল প্রদেশের অপারেশন প্রধান হন।
২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হলে, বাগদাদির সঙ্গে সমঝোতা করে তিনি সিরিয়ায় আইএস শাখা গঠনের দায়িত্ব নেন। মাত্র এক বছরে তিনি প্রায় ৫ হাজার যোদ্ধা নিয়োগ দেন এবং তাদের সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে মোতায়েন করেন। সে সময় পশ্চিমা প্রচারণা সাধারণ মানুষকে সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উসকে দেয়।
২৪ জানুয়ারি ২০১২ জোলানি “জাবহাত আল-নুসরা লি আহল আল-শাম” গঠনের ঘোষণা দেন এবং দেইর ইয-জোর প্রদেশের শুহেইল গ্রামকে এর সদর দপ্তর বানান। তিনি সিরিয়ার জনগণকে অস্ত্র হাতে সরকার উৎখাতের আহ্বান জানান।
৯ এপ্রিল ২০১৩ আবু বকর আল-বাগদাদি জাবহাত আল-নুসরা ও ইসলামিক স্টেট অব ইরাক একীভূত করে “আইএসআইএস” গঠনের ঘোষণা দেন। কিন্তু জোলানি এই একীভূতকরণ প্রত্যাখ্যান করেন এবং কিছুদিন পর আল-কায়েদা নেতা আইমান আল-জাওয়াহিরির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র জাবহাত আল-নুসরাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। মে ২০১৩-এ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জোলানিকে “আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী” ঘোষণা করে তার সম্পদ জব্দ করে এবং মার্কিন নাগরিকদের তার সঙ্গে যোগাযোগ নিষিদ্ধ করে। পরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদও তাকে ভ্রমণ ও অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে।
১০ মে ২০১৭ যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে, তার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। কিন্তু ডিসেম্বর ২০২৪-এ সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন এবং জোলানির ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র সেই পুরস্কার প্রত্যাহার করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, তার ওপর আর কোনো পুরস্কার নেই।
বিতর্ক ও প্রশ্ন
এখন প্রশ্ন উঠছে—যে ব্যক্তি একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের একজন ছিলেন, তিনি কীভাবে আজ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্ততা দেওয়ার সুযোগ পেলেন? সমালোচকরা বলছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতাপূর্ণ নীতি ও অঙ্গীকারের এক বিরাট বৈপরীত্যের উদাহরণ। মার্কিন প্রশাসন এখনো এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি।