কেন ইসলাম দাসপ্রথা বিলোপ করেনি? — একটি গবেষণামূলক বিশ্লেষণ
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কেন ইসলাম দাসপ্রথা বিলোপ করেনি? — একটি গবেষণামূলক বিশ্লেষণ
মিডিয়া মিহির: দাসপ্রথা মানবসভ্যতার প্রাচীনতম ও অমানবিক সামাজিক কাঠামোগুলোর একটি। প্রাচীন ইরান, মিশর, গ্রিস ও রোমের মতো সাম্রাজ্যে দাসরা ছিল অর্থনীতির চালিকাশক্তি, অথচ তাদের মানবিক অধিকার প্রায় শূন্য ছিল। ইসলাম এমন এক সময়ে আত্মপ্রকাশ করে, যখন দাসপ্রথা ও বর্ণবাদ সমাজের গভীরে শিকড় গেড়ে বসেছিল। তাই ইসলামকে বুঝতে হলে কেবল ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে নয়, বরং ঐতিহাসিক ও মানবমুক্তির ধারাবাহিকতার আলোকে বিচার করতে হবে।
ইসলামের আগমন ও বাস্তবতা
১৪০০ বছর আগে দাসপ্রথা ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অংশ। দাসরা পরিবারের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। তথাকথিত “সভ্য সমাজগুলোতেও” এ প্রথা বহাল ছিল। এমনকি আধুনিক ইউরোপ ও আমেরিকায় মাত্র দেড় শতাব্দী আগে পর্যন্ত দাসপ্রথা বৈধ ছিল। এ প্রেক্ষাপটে ইসলামের অবস্থানকে ন্যায়সঙ্গত ও প্রগতিশীল রূপে মূল্যায়ন করতে হবে।
ইসলামের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলাম হঠাৎ কোনো “ডিক্রি” জারি করে দাসপ্রথা বিলোপ করেনি, বরং ধাপে ধাপে ও সংস্কৃতিগত রূপান্তরের মাধ্যমে এটি বিলোপের পথ প্রশস্ত করেছে।
১. নৈতিক ভিত্তির ধ্বংস: ইসলাম ঘোষণা করে—মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণ, জাতি বা শ্রেণীতে নয়; বরং তাকওয়ায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বেলাল হাবশি (র.)-কে প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে নিযুক্ত করেন—যা ছিলবর্ণবাদের বিরুদ্ধে যুগান্তকারী ঘোষণা।
২. নতুন দাস সৃষ্টির পথ বন্ধ: ইসলাম দাস হওয়ার পথ কঠোরভাবে সীমিত করে দেয়। কেবল বৈধ যুদ্ধের বন্দিদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত হয়, যেখানে বিপক্ষ পক্ষও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করত।
৩. দাসমুক্তির প্রতি উৎসাহ: কুরআন দাসমুক্তিকে ইবাদত ও অনেক গুনাহর কাফফারাহ হিসেবে ঘোষণা করে। যাকাতের একটি অংশ দাসমুক্তির জন্য নির্ধারণ করে।
কুরআনের নির্দেশনা
সুরা মায়েদাহ (৫:৮৯)→ গুনাহর কাফফারাহ হিসেবে দাসমুক্তি। সুরা নিসা (৪:৯২)→ অনিচ্ছাকৃত হত্যার কাফফারাহ দাসমুক্তি।সুরা তাওবা (৯:৬০)→ যাকাতের খাতগুলোর একটি দাসমুক্তি। সুরা বালাদ (৯০:১৩)→ দাসমুক্তিকে মহৎ কাজ বলা হয়েছে। সুরা নূর (২৪:৩৩)→ “মুকাতাবাহ” চুক্তির মাধ্যমে দাসকে মুক্ত হওয়ার অধিকার দেওয়া।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আহলে বাইত (আ.)-এর সীরাত
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ সেই, যে মানুষকে বিক্রি করে।” [আল-কাফি, খণ্ড ৫, পৃ. ১১৪]
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, “আমি আমার উপার্জন থেকে এক হাজার দাস কিনে মুক্ত করেছি।” [আল-কাফি, খণ্ড ৫, পৃ. ৭৪] এ সীরাত প্রমাণ করে, দাসমুক্তি ইসলামী নেতৃত্বের একটি কর্মসূচি ছিল।
মানবাধিকারের সুরক্ষা
ইসলাম দাসদের ওপর নির্যাতন ও অঙ্গহানি নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি প্রভু যদি দাসের কান বা নাক কেটে দিত, তবে দাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুক্ত হয়ে যেত। >শরহুল লুমআতুদ-দিমাশকিয়া, খণ্ড ৬, পৃ. ২৮০]
আধুনিক মানবাধিকার ধারণার আলোকে
আজকের বিশ্ব মানবাধিকারের মৌল নীতি হিসেবে স্বাধীনতা ও সমতার কথা বলে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ (১৯৪৮) দাসপ্রথাকে মানববিরোধী অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে লক্ষ্যণীয় যে—ইসলাম ১৪০০ বছর আগে থেকেই দাসমুক্তিকে ইবাদত, সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিক মূল্যবোধ হিসেবে প্রবর্তন করেছিল।
যেখানে পশ্চিমা সমাজ কেবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপের কারণে দাসপ্রথা বিলোপ করে, ইসলাম এটি একটি আধ্যাত্মিক ও মানবিক কর্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলামের কৌশলগত ধাপগুলো আধুনিক “ট্রানজিশনাল জাস্টিস” বা ধাপে ধাপে সংস্কারের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
পরিসমাপ্তি, ইসলাম দাসপ্রথা সৃষ্টি করেনি, বরং ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্যে থেকে ধাপে ধাপে বিলোপের পথ খুলে দিয়েছে। নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি ভেঙে দাসপ্রথাকে অমানবিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দাসমুক্তিকে ইবাদত, কাফফারাহ ও যাকাতের খাত হিসেবে নির্ধারণ করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আহলে বাইত (আ.) সীরাতে বাস্তব উদাহরণ রেখে গেছেন। আধুনিক মানবাধিকারের আলোকে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল অগ্রসরই নয়, বরং পূর্বসূরি।
অতএব, ইসলাম একদিকে ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করেছে, অন্যদিকে মানবমুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে—একটি দাসমুক্ত ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজ।