ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কাতারের জবাব কী হবে? ৭ আঞ্চলিক বিশ্লেষকের দৃষ্টিভঙ্গি
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: সম্প্রতি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান দোহায় হামাস প্রতিনিধিদলের বৈঠক লক্ষ্যবস্তু করলে পুরো অঞ্চল জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে ৭ জন আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞ কাতারের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে মতামত জানিয়েছেন। তাদের বিশ্লেষণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব, উপসাগরীয় দেশগুলোর সীমাবদ্ধতা এবং কাতারের রাজনৈতিক বিকল্পগুলো উঠে এসেছে ।
মঙ্গলবার ১৮ই সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান দোহা শহরের কেন্দ্রস্থলে হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রতিনিধি দলের বৈঠককে লক্ষ্যবস্তু করে। এই ঘটনা দ্রুতই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ওয়াশিংটন যেখানে গাজায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন তথাকথিত “শান্তি প্রস্তাব”-এর বিষয়ে হামাসের উত্তরের অপেক্ষায় ছিল, সেই মুহূর্তেই দোহায় এ হামলা সংঘটিত হয়।
বিভিন্ন পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই হামলা কার্যত ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য আলোচনার প্রচেষ্টায় ধ্বংসাত্মক আঘাত হেনেছে।
কাতারে ইসরায়েলি বিমান হামলা আরও একটি বাস্তবতা স্পষ্ট করে দিয়েছে—এ অঞ্চলে কোনো দেশই নিরাপদ নয়, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতারও নয়। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত কাতার সপ্তম দেশ, যেটি ইসরায়েলের বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তু হলো।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল-থানি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করে ইসরায়েলের এ হামলাকে “রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ” আখ্যা দেন এবং সতর্ক করে বলেন—“অঞ্চল থেকে একটি জবাব আসছে।” এই আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা নিয়ে মেহর নিউজ এজেন্সির সাংবাদিক ৭ জন বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি নিচে তুলে ধরা হলো:
কাতারের কোনো বাস্তব জবাব আসবে না: সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভি
ইরাকে নুজবা আন্দোলনের মহাসচিবল সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভি বলেন, “আমেরিকার প্রভাব ও আধিপত্যের কারণে কাতার কোনো বাস্তব প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। তাদের বিবৃতিগুলো শুধুই রাজনৈতিক—মুখরক্ষা করার কৌশল। এসব কেবল বিশ্বকে দেখানোর জন্য, যেন বোঝানো যায় তারা শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। যে দেশ মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি—আল-উদেইদ এয়ারবেস—আয়োজক এবং যে ইসরায়েলকে কার্যত আমেরিকার একটি সামরিক ডিভিশন মনে করে, সে কীভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বাস্তব সামরিক প্রতিক্রিয়া জানাবে?”
কাতারের প্রতিক্রিয়া আশা করা যায় না: আহমেদ আল-শামী
ইয়েমেনের আল-মাসিরা টিভির সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আহমেদ আল-শামী বলেন, “দুঃখজনকভাবে কাতারের শাসকগোষ্ঠী সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে। তাদের সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমেরিকার হাতে। তাই ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া আশা করা যায় না। কাতারের একমাত্র পথ হলো—আমেরিকান ঘাঁটিগুলোকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা, স্বাধীনতার দিকে এগোনো, আর গণহত্যার অংশীদার হওয়া থেকে বিরত থাকা। নইলে তাদের সেই হাত থেকেই আঘাত আসবে, যাদের ওপর ভরসা করেছে—যেমন দোহায় ইসরায়েলের হামলা আমেরিকার পূর্ণ সমর্থনে হয়েছিল।”
আরব অস্ত্র আমেরিকার অনুমতি ছাড়া ব্যবহার অযোগ্য: মোহাম্মদ মাশিক
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মাশিক বলেন, “কাতার ধনী দেশ, কিন্তু সামরিকভাবে ইসরায়েলের তুলনায় দুর্বল। তাই তাদের একতরফা সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাতার কেবল আন্তর্জাতিক মহলের—বিশেষত আঞ্চলিক দেশগুলোর—সহযোগিতা নিয়ে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করবে।
আমার মতে, কয়েকটি কারণে কাতার সামরিক প্রতিক্রিয়া দেবে না: ১. উপসাগরীয় দেশগুলো ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। ২. উপসাগরে আমেরিকান ঘাঁটি রয়েছে এবং ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সেগুলোর উপর দিয়েই উড়েছে। ৩. আরব দেশগুলোর হাতে থাকা পশ্চিমা অস্ত্র আমেরিকার অনুমতি ছাড়া ব্যবহারযোগ্য নয়—বিশেষত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান। ৪. গাজায় গণহত্যার পাশাপাশি ইসরায়েল ইতিমধ্যে একাধিক আরব দেশে হামলা চালিয়েছে, অথচ কেউ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ৫. আরব দেশগুলোর স্বার্থ ভিন্ন, আর প্রযুক্তিগত ব্যবধানের কারণে তারা সামরিক পদক্ষেপ নিতে সাহস পাবে না। তবে কাতার সম্ভবত জাতিসংঘে প্রস্তাব আনার চেষ্টা করবে—যদি যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দেয়।”
ওয়াশিংটনের চাপ বড় বাধা: বুসাইনা আলিক
আল-মায়াদিনের সাংবাদিক বুসাইনা আলিক বলেন, “আশা করি কাতারের প্রতিক্রিয়া সামষ্টিক হবে—আরব দেশগুলো, তুরস্ক ও ইরানের সমন্বয়ে। তবে বাস্তবে এটি অসম্ভাব্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এমন চাপ সৃষ্টি করবে যা কোনো প্রতিক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় বা অর্থহীন করে দেবে।”
প্রতিক্রিয়া শুধু কাতারের হবে না: কিয়ান আল-আসাদি
কিয়ান আল-আসাদি, ইরাকি বিশ্লেষক বলেন, “যে কোনো প্রতিক্রিয়া এককভাবে কাতারের নয়, বরং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) কাঠামোতে হতে পারে। তবে যেহেতু জিসিসির সব সিদ্ধান্ত আমেরিকার ছত্রছায়ায়, তাই সামরিক বিকল্প একেবারেই বাদ দিতে হবে।
তবে কাতারের হাতে কিছু কূটনৈতিক হাতিয়ার রয়েছে: যেমন স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা, আঞ্চলিক অঙ্গীকার পুনর্মূল্যায়ন, কিংবা ওয়াশিংটনের সঙ্গে সরাসরি চ্যানেল ব্যবহার করে মানবিক সহায়তা ও সীমান্ত খোলার জন্য ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এখন প্রশ্ন হলো—কাতার কি শুধু বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি রাজনৈতিক ও মানবিক অঙ্গনে বাস্তব পদক্ষেপ নেবে? আগামী দিনগুলোই কাতারের অবস্থান স্পষ্ট করবে।”
কাতারের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়েছে: কিয়ান আল-আসাদি
মোহাম্মদ বায়াত বলেন, “কাতার এর আগে ইরানের প্রতিরোধে টার্গেট হয়েছিল, আর এবার ইসরায়েল দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করেছে। এতে কাতারের প্রতিরোধ-ধারণা ভেঙে পড়েছে। তারা এখন মরিয়া হয়ে সম্মান রক্ষার চেষ্টা করবে।
সম্ভবত কাতার ন্যূনতম হলেও দক্ষিণ দখলকৃত ভূমিতে কোনো প্রতীকী প্রতিক্রিয়া দেখাবে—হয়তো কোনো সীমিত বিমান হামলা। তবে এতে আঞ্চলিক শক্তিগুলো অংশ নেবে না—সৌদি আরব, আমিরাত বা এমনকি ইরানের অংশগ্রহণও সম্ভাবনা কম।”
কাতারের পক্ষে প্রতিক্রিয়া অসম্ভব: আলী ফজলুল্লাহ
আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী ফজলুল্লাহ বলেন, “এই ইসরায়েলি-আমেরিকান হামলা কাতারের বিরুদ্ধে ছিল এক ‘রেড লাইন’ অতিক্রম। ওয়াশিংটনের দেওয়া নিরাপত্তার সব নিশ্চয়তা ভেস্তে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসন এক মাস আগেই কাতারকে নিরাপত্তা আশ্বাস দিয়েছিল, কিন্তু সেটি টিকলো না। আজ ইসরায়েলের হামলা প্রমাণ করেছে—আমেরিকার প্রতিশ্রুতি মিথ্যা।
উপসাগরীয় শাসকরা শুধু নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্যই নিরাপত্তা খোঁজে। কিন্তু বাস্তবে তারা অরক্ষিত। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কঠোর বিবৃতি সত্ত্বেও বাস্তব প্রতিক্রিয়া আসবে না। কাতারের পক্ষে ইসরায়েল বা আমেরিকার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। আমেরিকাও নিশ্চিত যে কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে না।” সব বিশেষজ্ঞের মতেই স্পষ্ট—কাতার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক প্রতিক্রিয়া জানাবে না। তাদের প্রতিক্রিয়া হবে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রতীকী পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও আধিপত্যই কাতারের সবচেয়ে বড় বাঁধা।