
মিডিয়া মিহির: এই বিষয়টি মরহুম আল্লামা তাবাতাবাই( রহ.) তাঁর তাফসীরে “মিজান” এ উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন:
“যে বুদ্ধি পুরুষের মধ্যে নারীর তুলনায় বেশি দেখা যায়, তা কেবল অতিরিক্ত একটি গুণ; এটি মানবিক কৃতিত্বের মানদণ্ড নয়।”
(আকল (عقل) বলতে সাধারণভাবে বোঝায় মানুষের যুক্তি, বুদ্ধি বা চিন্তা করার ক্ষমতা)
বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, কিছু মানুষ মনে করেন ইসলাম অনুযায়ী বুদ্ধিই মানুষের পরিপূর্ণতার মানদণ্ড। অর্থাৎ যে ব্যক্তি বেশি বুদ্ধিমান, সে মানবিক পরিপূর্ণতার দিকে বেশি এগিয়ে এবং আল্লাহর কাছে নিকটতম। আর যার বুদ্ধি কম, সে কম পরিপূর্ণ এবং আল্লাহর নিকটতম অবস্থায় কম। অনেকে যুক্তি দেন: যেহেতু পুরুষের বুদ্ধি নারীর তুলনায় বেশি, তাই পুরুষ আল্লাহর কাছে নারীর চেয়ে নিকটতম।
কিন্তু এই যুক্তি ভুল; এটি শব্দের অস্পষ্টতার কারণে তৈরি একটি বিভ্রান্তি। কারণ “বুদ্ধি” শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়। তাই প্রথমে স্পষ্ট করতে হবে, কোন ধরনের বুদ্ধিই মানবিক পরিপূর্ণতা ও আল্লাহর নিকটতম অবস্থার মানদণ্ড। দ্বিতীয়ত, কোন বুদ্ধিতে পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে?
ভুল ধারণার মূল কারণ হলো, পুরুষ ও নারীর বুদ্ধিতে পার্থক্য থাকা এবং বুদ্ধি আল্লাহর নিকটতম অবস্থার মানদণ্ড—এ দুটি ভিন্ন বিষয়। যে বুদ্ধিতে পার্থক্য দেখা যায়, তা আল্লাহর নিকটতম অবস্থার বুদ্ধি নয়।
যদি দুই অর্থ আলাদা করে দেখা হয়, দেখা যায়, পুরুষের বুদ্ধিকে নারীর চেয়ে “সেরা” হিসেবে প্রমাণ করা যায় না। কারণ যে বুদ্ধিতে পার্থক্য দেখা যায়, তা মূলত তাত্ত্বিক বা বাস্তবিক জ্ঞান—যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, পরীক্ষামূলক বা গণিত সম্পর্কিত জ্ঞান।
ধরে নিন, পুরুষ এই ধরনের জ্ঞানে নারীর চেয়ে ভালো (যা প্রমাণ করা সহজ নয়)। তবুও প্রশ্ন থাকে: আল্লাহর নিকটতম অবস্থার বুদ্ধি কি একই বুদ্ধি যা পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে? আমরা কি বলতে পারি, যে ব্যক্তি পদার্থবিজ্ঞান, গণিত বা চিকিৎসা ভালো বোঝে, সে আল্লাহর কাছে নিকটতম? না, আল্লাহর কাছে নিকটতম বুদ্ধি হলো সেই বুদ্ধি যা মানুষকে আল্লাহর ইবাদত এবং জান্নাত অর্জনে সাহায্য করে।
একজন মানুষ হয়তো বাস্তবিক জ্ঞান বা নীতি ভালো বোঝে, কিন্তু নিজের বাসনা নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম। ইতিহাসে সমস্ত মিথ্যা ধর্ম যা নবীদের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে, তা পুরুষদের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ ধর্মবিরোধী যারা নবীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তারা পুরুষই ছিলেন। আল-কুরআনও ফরাসির মতো প্রতিকৃত ধর্ম সৃষ্টি করা ব্যক্তিদের বর্ণনা করে:
“يَقْدُمُ قَوْمَهُ يَومَ الْقِيامَةِ“
যারা অন্যদের আগে জাহান্নামে যাবে, তারা কি পুরুষ ছিল না নারী?
অতএব, যদি কেউ বৈজ্ঞানিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশি বুদ্ধি রাখে, তা আল্লাহর নিকটতম অবস্থার নিদর্শন নয়; বরং এটি অতিরিক্ত একটি গুণ মাত্র। কারণ, “যে জ্ঞান জানার অভাবে ক্ষতি হয় না।”
যদি কেউ দাবী করে যে পুরুষের বুদ্ধি আল্লাহর ইবাদত ও জান্নাত অর্জনের ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় বেশি শক্তিশালী, তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়, কারণ তা অভিজ্ঞতা বা যুক্তি দ্বারা সমর্থিত নয়।
সব পূর্ণতা কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানের উপর নির্ভর করে না। একজন মানুষ ভালো বোঝে, কিন্তু যদি তার বোঝাপড়া সহিংস হয়, তা উপকারে আসে না। মানুষ দুই ধরনের: কিছু শক্তিশালী কর্মক্ষম, যাকে পুরুষ বলা হয়; কিছু সূক্ষ্ম মনোভাবসম্পন্ন, যাকে নারী বলা হয়। আল্লাহর নামও দুই ধরনের এবং পূর্ণতা মানুষকে দুইভাবে প্রদত্ত। কিছু পূর্ণতা আসে শক্তি, প্রতিরোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই এবং কঠোরতার মাধ্যমে; কিছু আসে মমতা, দয়া, ভালোবাসা, সৌন্দর্য ও স্নেহের মাধ্যমে।
পুরুষ যদি শক্তি ও কঠোরতায় নারীর চেয়ে বেশি হয়, তা প্রমাণ করে না যে তিনি মমতা, দয়া, সহানুভূতি, সৌন্দর্য ও স্নেহের ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে শক্তিশালী।
পরম আল্লাহ দয়া ও ভালোবাসার মাধ্যমে জগত পরিচালনা করেন এবং কুরআনের অনেক আয়াত ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। এই ভালোবাসার পথ নারীরা পুরুষের তুলনায় ভালো বোঝে, যদিও কঠোরতার পথ হয়তো পুরুষ বেশি বোঝে।