ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর বিশেষ দৃষ্টি: গায়বাতের যুগের জন্য শিয়াদের প্রস্তুতকরণ

মিডিয়া মিহির: শিয়া মুসলমানদের একাদশ ইমাম, ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর জীবন ও নেতৃত্ব ছিল এক কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত। মাত্র ২৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি এমন এক সময়ে দায়িত্ব পালন করেন, যখন আব্বাসীয় খলিফাদের দমননীতি শিয়া ইমামদের কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছিল। তবুও, তিনি অসাধারণ ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির মাধ্যমে শিয়াদের শুধু ঐক্যবদ্ধই রাখেননি, বরং তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য—বিশেষ করে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়বাতের যুগের জন্য—প্রস্তুত করেছিলেন।
জন্ম ও উপাধি
ইমাম হাসান আসকারি (আ.) হিজরি ২৩২ সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। শাসকগোষ্ঠীর বাধ্যবাধকতায় তাঁকে সামরিক নগরী সামারার “আসকার” অঞ্চলে বসবাস করতে হয়, যা থেকেই তাঁর “আসকারি” উপাধির উৎপত্তি। খলিফাদের কঠোর নজরদারি এতটাই ছিল যে, তাঁকে প্রতি সপ্তাহে শাসকের দরবারে হাজিরা দিতে হতো, যাতে তিনি শহর ত্যাগ না করেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
ইমাম আসকারি (আ.)-এর ইমামতের সময়কাল ছিল এক জটিল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজনের যুগ।
কঠোর নজরদারি: সর্বক্ষণ তাঁর চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো।
মতপার্থক্যের বিস্তার: শিয়া সমাজ নানা বিশ্বাসগত ও মতাদর্শিক বিভাজনের সম্মুখীন হয়েছিল।
ইমামত নিয়ে সন্দেহ: কিছু লোক তাঁর ভাই জাফর ইবনে আলী কিংবা ইমাম হাদী (আ.)-এর পুত্র সাইয়্যেদ মুহাম্মদের ইমামতে বিশ্বাস করত। এ বিষয়ে ইমাম স্বয়ং বলেছেন, “আমার ইমামত নিয়ে যত সন্দেহ করা হয়েছে, কোনো ইমামের ইমামত নিয়ে ততটা হয়নি।”
রাজনৈতিক বিদ্রোহ: বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, যেখানে শিয়াদের সমর্থন নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছিল। এই প্রেক্ষাপটে ইমাম (আ.)-এর প্রধান দায়িত্ব ছিল— ১. শিয়া সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, ২. তাদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, ৩. অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগণকে সহায়তা করা, ৪. সর্বোপরি, গায়বাতের যুগের জন্য শিয়াদের প্রস্তুত করা।
শিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার উপায়
সরকারি সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইমাম আসকারি (আ.) নানা উপায়ে শিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
সরাসরি সাক্ষাৎ: সরকারি দপ্তরে যাওয়ার পথে কিছু শিয়া ইমামের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ করতেন। তবে পরে নিরাপত্তার কারণে ইমাম লিখিতভাবে তাঁদেরকে এমন সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকতে বলেন।
চিঠি প্রেরণ: তিনি কোম ও আওয়া অঞ্চলের শিয়াদের উদ্দেশ্যে একাধিক চিঠি লিখে দিকনির্দেশনা দেন।
দূত প্রেরণ: নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের বিভিন্ন শহরে পাঠিয়ে মানুষের সমস্যার সমাধান করাতেন।
প্রতিনিধি ব উকিল নিয়োগ: তিনি একটি শক্তিশালী “উকালাত নেটওয়ার্ক” গড়ে তোলেন, যারা খুমস সংগ্রহ, প্রশ্নোত্তর ও সামাজিক নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করত।
শিষ্য তৈরি ও জ্ঞান প্রচার: ইমাম (আ.) উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভবিষ্যতের জন্য এমন আলেম ও প্রতিনিধিদের গড়ে তোলা জরুরি, যারা তাঁর অনুপস্থিতিতেও শিয়া সমাজকে দিকনির্দেশনা দিতে পারবে। এ লক্ষ্যে তিনি বহু মেধাবী ছাত্র ও প্রতিনিধি তৈরি করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
উসমান ইবনে সাঈদ আমরি: ইমাম আসকারি (আ.)-এর প্রধান প্রতিনিধি, যিনি পরে গায়বাত সুগরা যুগে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর প্রথম নায়েব হন।
মুহাম্মদ ইবনে উসমান: তাঁর পুত্র, যিনি পরবর্তী সময়ে উকিল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আহমদ ইবনে ইসহাক আশআরি: (বর্তমান ইরানের) কোম শহরের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি।
আহমদ ইবনে মুহাম্মদ বরকী: বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মাহাসিন এর রচয়িতা।
আবু হাশিম দাউদ ইবনে কাসিম জাফারি ও আবু সাহল ইসমাইল ইবনে আলী নৌবাখতি: প্রখ্যাত আলেম ও ধর্মতত্ত্ববিদ। শায়খ তূসীর বর্ণনা অনুযায়ী, ইমাম আসকারি (আ.)-এর একশোরও বেশি বিশেষ শিষ্য ছিল, যারা তাঁর শিক্ষা ছড়িয়ে দেন।
গায়বাতের যুগের প্রস্তুতি ইমাম আসকারি (আ.)-এর জীবনের অন্যতম প্রধান দিক ছিল শিয়াদের ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়বাতের যুগের জন্য প্রস্তুত করা। তিনি প্রতিনিধি নিয়োগ, চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ এবং নির্ভরযোগ্য উকিলদের মাধ্যমে সমাজকে শিক্ষা দিয়ে বুঝিয়ে দেন—ইমামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক সবসময় সম্ভব নয়; বরং প্রতিনিধি ও নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই নেতৃত্ব বজায় রাখতে হবে।
ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনকাল হলেও, তাঁর কৌশলগত প্রজ্ঞা, শিক্ষাদান, প্রতিনিধি গঠন এবং শিয়াদের মানসিক প্রস্তুতকরণ আজও ইসলামী ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন কেবল ইতিহাসের অধ্যায় নয়, বরং আজও শিয়াদের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক পরিচয়ের ভিত্তি।