ইতিহাসধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

হযরত মহানবী (সা.) ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিন

মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন | প্রকাশ: ২৭ আগষ্ট, ২০২৫

হযরত মহানবী (সা.) ইমাম জাফর সাদিক (.)-এর পবিত্র জন্মদিন

মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম)

হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিন হলো আমুল ফীল সালের প্রথম মাস, ১৭ রবিউল আউয়াল। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুলমুত্তালিব এবং মাতা আমিনা বিনতে ওয়াহাব-এর ঘরে। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল ও নূরের আভা দ্বারা অন্ধকারাচ্ছন্ন দুনিয়া আলোকিত হয়।

পিতার ইন্তেকাল মাতার মৃত্যু

হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। গর্ভবতী আমিনা (রাযি.)-এর অবস্থায় তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে শাম সফরে যান। ফেরার পথে ইয়াসরিবে (বর্তমান মদিনা মুনাওয়ারা) অসুস্থ হয়ে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। নবজাতক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে তিনি দেখতে পাননি। হযরত আবদুল্লাহর ইন্তেকাল নবীজীর জন্মের দুই মাস বা সাত মাস আগে ঘটেছিল বলে বর্ণনা পাওয়া যায়।

মহানবীর মা আমিনা (রাযি.), যিনি কুরাইশ নারীদের মধ্যে তাকওয়া, পবিত্রতা ও সতীত্বের জন্য খ্যাত ছিলেন, নবীজীর জন্মের পর অল্পকাল বাঁচেন। এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) জন্মের দুই বছর চার মাস পরে, আরেক বর্ণনায় ছয় বছর পরে ইয়াসরিব সফর থেকে ফেরার পথে “আবওয়া” নামক স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন।

নবীজীর জন্মের সাথে অলৌকিক ঘটনাবলি

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, ইবলিস আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত হলেও সাত আসমানের মধ্যে যাতায়াত করতে পারত। হযরত ঈসা (আ.)-এর আগমনের পর ইবলিসকে উপরকার তিন আসমান থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। আর হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর জন্মের সময় ইবলিসকে সম্পূর্ণভাবে সব আসমান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সব শয়তানকে শিহাব (উল্কা) নিক্ষেপের মাধ্যমে বিতাড়িত করা হয়।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের সময় একাধিক অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়—

  • কিসরার প্রাসাদ ফেটে যায় এবং কিছু মিনার ভেঙে পড়ে।
  • ফারসের শতবর্ষব্যাপী জ্বলতে থাকা অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়।
  • সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যায়।
  • মক্কার মূর্তিগুলো উপড়ে পড়ে।
  • আকাশে নবীজীর নূরের কিরণ ছড়িয়ে পড়ে, যা বহু ফারসাখ দূর পর্যন্ত আলো ছড়ায়।

নবীজী ভূমিতে আগমনের পর প্রথম উচ্চারণ করেন:
আল্লাহু আকবার, আলহামদুলিল্লাহি কাসীরান, সুবহানাল্লাহি বুকরাতাও ওয়া আসিলা।

 اللّهُ أَكْبَرُ، الْحَمْدُ لِلّهِ كَثِيرًا، سُبْحَانَ اللّهِ بُكْرَةً وَأَصِيلًا

শিয়া ও সুন্নি ইতিহাসবিদরা একমত যে নবী করীম (সা.)-এর জন্ম আমুল ফীল সালে, খ্রিস্টাব্দ ৫৭০ সালের সমতুল্য, মাসটি ছিল রবিউল আউয়াল। তবে জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে শিয়া মতে ১৭ রবিউল আউয়াল, আর সুন্নি আলেমদের মতে ১২ রবিউল আউয়াল।

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিন ও জীবনকাহিনী

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) জন্মগ্রহণ করেন হিজরি ৮৩ সালের ১৭ রবিউল আউয়াল, শুক্রবার ফজরের সময় (আরেক বর্ণনায় সোমবার)। তাঁর পবিত্র নূরের আলো মানব সমাজকে আলোকিত করেছে। পিতার নাম ইমাম মুহাম্মদ বাকির (আ.) এবং মাতার নাম ফাতিমা, যিনি উম্মে ফারওয়া নামে পরিচিত ছিলেন। পূর্বপুরুষের চাচা জাফর তাইয়ার (আ.)-এর নামে তাঁকে “জাফর” নামকরণ করা হয়।

হযরত জাফর ইবনে মুহাম্মদ (আ.)-এর একটি সুপরিচিত কুনিয়াত ছিল আবু আবদুল্লাহ, এছাড়াও দুটি কম পরিচিত কুনিয়াত ছিল আবু ইসমাঈল ও আবু মূসা। তাঁর পদবি ও উপাধির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: সাদিক, সাবির, তাহির ও ফাজেল। শিয়া মুসলমানরা এবং আহলে বাইতের প্রেমিকরা তাঁকে “সাদিক আলে মুহাম্মদ (সা.)” নামে চেনে, কারণ তিনি কখনও সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলেননি।

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর পিতার বংশধারা দুই প্রজন্মে পৌঁছে যায় আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)-এর কাছে এবং তিন প্রজন্মে পৌঁছে যায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে।

মাতার চরিত্র ও শিক্ষা

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর সম্মানিত মা ফাতিমা (উম্মে ফারওয়া) ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম সৎ, নেক ও উত্তম চরিত্রের নারী। ইমাম সাদিক (আ.) মায়ের প্রসঙ্গে বলেছেন:

“আমার মা সেই নারীদের একজন ছিলেন, যিনি ঈমানদার, পরহেজগার ও সৎকর্মশীলা ছিলেন, এবং আল্লাহ নেককারদের ভালোবাসেন।”

শিক্ষা ও ইমামত

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ১২ বছর তাঁর দাদা ইমাম জাইনুল আবেদীন (আ.)-এর বরকতময় জীবন লাভ করেছেন এবং তাঁর শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হন। এছাড়াও তিনি ৩২ বছর পিতা ইমাম মুহাম্মদ বাকির (আ.)-এর ছায়াতলে ছিলেন এবং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় তাঁর পাশে ছিলেন।

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ইমামতের সময়কাল ছিল ৩৩ বছর ১০ মাস (যিলহজ ১১৪ হিজরি থেকে শাওয়াল ১৪৮ হিজরি পর্যন্ত)। এই সময়ে তিনি বহু উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকের শাসনামল প্রত্যক্ষ করেছেন:

  1. আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান (৬৫–৮৬ হিজরি)
  2. ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক (৮৬–৯৬ হিজরি)
  3. সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক (৯৬–৯৯ হিজরি)
  4. উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (৯৯–১০১ হিজরি)
  5. ইয়াজিদ ইবনে আব্দুল মালিক (১০১–১০৫ হিজরি)
  6. হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক (১০৫–১২৫ হিজরি)
  7. ওয়ালিদ ইবনে ইয়াজিদ (১২৫–১২৬ হিজরি)
  8. ইয়াজিদ ইবনে ওয়ালিদ (১২৬ হিজরি)
  9. মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ (১২৬–১৩২ হিজরি)
  10. আবুল আব্বাস সাফাহ (১৩২–১৩৬ হিজরি)
  11. মানসুর দাওয়ানেকি (১৩৬–১৫৮ হিজরি)

প্রথম নয়জন উমাইয়া বংশের এবং শেষের দুজন আব্বাসীয় বংশের শাসক ছিলেন। এই দুই বংশ থেকেই ইমাম সাদিক (আ.) কঠোর কষ্ট ও অবিচারের শিকার হন। তবে তিনি উমাইয়া শাসনের অবসানকাল ও আব্বাসীয় শাসনের সূচনাকালে বেঁচে থাকায়, এই দুই গোষ্ঠীর ক্ষমতার লড়াইয়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আহলে বাইতের মক্তবকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পরিচিত এবং প্রসারিত করতে সক্ষম হন।

বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় অবদান

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) মদিনায় একটি হাওযা ইলমিয়া (ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ) প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিশিষ্ট শিষ্যদের (যেমন: হিশাম, জরারা ও মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম) শিক্ষা দেন। তাঁর এই উদ্যোগ ইসলামের জগতে, বিশেষ করে শিয়া মাযহাবে, এক বিরাট পরিবর্তন সৃষ্টি করে। এজন্য তাঁকে “মাযহাব ইমামিয়া-এর ভিত্তি স্থাপনকারী” বলা হয় এবং শিয়া ইমামিয়া ইসনাআশারীদেরকে “শিয়া জাফারিয়া” বলা হয়।

শাহাদাত ও সমাধি

৬৫ বছর বয়সে, আব্বাসীয় খলিফা মানসুর দাওয়ানেকি-এর নির্দেশে তাঁর এজেন্টদের মাধ্যমে প্রদত্ত বিষের কারণে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) শহীদ হন। তাঁর শাহাদাতের তারিখ হলো ২৫ শাওয়াল ১৪৮ হিজরি।

ইমাম মূসা কাযিম (আ.) তাঁর অন্যান্য ভাইবোনদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পিতার পবিত্র দেহকে গোসল, কাফন ও জানাজার পর মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে, তাঁর পিতা, দাদা ও পিতার চাচার পাশে সমাহিত করেন।

সূত্রসমূহ

  1. কুরআন হাদিস
    • কোরআন, সূরা আল-আম্বিয়া ২১:১
    • সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম
  2. শিয়া সুন্নি ইতিহাস
    • আল-মীজান ফি তফসীরিল কোরআন, আলী ক্বারই
    • সীরাতুন নবী (ইবনে ইশাক, ইবনে হিশাম)
    • তাফসীরুল মুল্লা, আলি শিরাজী
  3. ইমাম জাফর সাদিক (.) সম্পর্কিত
    • আল-আমালী, শিহাবুদ্দিন, ত্বূসি
    • কাশফুল গুম্মা, আল-হুরায়রা
    • শিয়া ইতিহাস: তাওস, নূরুলা’বেদিন

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button