৭১-এর দায় ও আদর্শিক সংকটে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী!
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ৭১-এর ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা থেকে আজও মুক্ত হতে না পারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, সম্প্রতি নতুন মাত্রায় সমালোচনার মুখে পড়েছে। কেন তাদেরকে নিয়ে এত বেশী সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সত্যিই কি তারা কলঙ্কের অঞ্জলি তুলে নিয়ে, সত্যকে জলাঞ্জলি দিয়েছে!? নাকি সবই শত্রুতামূলক?
সম্প্রতি ভারতের মন রক্ষা করে চলাসহ, দূর্গা-পূজার উৎসবের প্রতি সহনশীলতা ও অসাম্প্রদায়িকতা দেখানোর নামে তাদের বিরুদ্ধে আকিদা ও আদর্শ বিসর্জন দেয়ার অভিযোগ উঠেছে এবং সেই সাথে যুক্ত হয়েছে দূর্গা-পূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি জামায়াত নেতৃত্বের শুভেচ্ছা বিনিময়ের বিষয়।
অতীতে দেশ বিভাগের বিরোধীতা করার দায়ে, তাদেরকে অপরাধী বলা যায় না, কারণ সেই সময়ের বাস্তবতায়, ভারতীয় আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে তখনকার সেই সিদ্ধান্তকে ভুল বলা যায় না ভুল ছিল না।
বাকি থাকে, জালিমের সহযোগি হওয়ার মত কিছু অমার্জনীয় অপরাধ! আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসনের দাবিতে স্বরব থেকেও, সেদিন বাংলাদেশের মানুষের উপর হওয়া জুলুম ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মত সাহস জামায়াত দেখাতে পারেনি। জুলুমের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা তো দূরের কথা, ইসলাম ও ন্যায় বিচারের খাতিরেও তারা না মজলুমের পাশে দাড়িয়ে ছিল আর না নিরপেক্ষ ছিল। ১৯৭১ সালে তাদের সেই ভূমিকা জাতির হৃদয়ে গভীর ক্ষত চিন্হ এঁকে দিয়েছে।
বর্তমানে জামায়াত ইসলামী নিজেদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিপরীতে পা রেখেছে এবং ভারতের মন জয় করতে গিয়ে, বর্তমানে তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের নামে যে ধরণের রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করছে, তার ফলে কখনো কখনো ইসলামী সীমা-রেখাও উপেক্ষা করা হচ্ছে। অথচ মিথ্যা ও কুট-কৌশলের ভণ্ডামিপূর্ণ রাজনীতিকে ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না এবং মুসলমানদের জন্য শিরক ও তাওহীদের মধ্যে কোনো মধ্যবর্তী পথ নেই।
ইসলামী মূল্যবোধ ও জাতীয় স্বার্থেরে উপরে রাজনৈতিক উদ্দেশকে প্রাধান্য দেওয়ায়, দলটির ভবিষ্যত ধীরে ধীরে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক স্বার্থে আদর্শিক সমঝোতা, দীর্ঘমেয়াদে কোনো দলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। ইসলামের মৌলিক নীতি ও মূল্যবোধের সাথে আপস করার মত অদূরদর্শি কাজ কর্ম জামায়াতের কপালে যে কলঙ্কের ছাপ ফেলছে, তা হয়তো আর কোনো দিন মুছে ফেলা সম্ভব হবে না।
মানুষের জীবনে ভূল করা কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়, কিন্তু সংশোধনের পথে না যেয়ে, গোঁড়ামি করা এবং একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে কুযুক্তি মিশ্রিত মিথ্যা-গল্প বানানো, আল্লাহর নিকট বড় ধরনের অন্যায় ও অপরাধের কাজ। এই ধরনের কাজে আল্লাহর লানত (অভিশাপ) অবধারিত। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে, মিথ্যা-রচনাকারীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ পতিত হোক। (৩/৬১)
সাময়িক ভাবে রাজনৈতিক সফলতা পেতে, সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে আবৃত করে রাখার কৌশল গ্রহন করে, যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, সেই স্বপ্নের চোখে এবং তাদের আশার গুড়ে অচিরেই বালি ঢেলে দিবে ইসলামের শত্রুরা।
শত্রুকে হালকা করে দেখা স্পষ্ট নির্বুদ্ধিতা; আর সেই ভুলের জন্য ইতোমধ্যে জামায়াতকেই মূল্য দিতে হচ্ছে। শত্রুকে হালকা ভাবে দেখার তিক্ত ফল-ফসল সর্বপ্রথম তাদের ঘরেই উঠছে! চোখ বন্ধ করে সমার্থন করা দলীয় নেতা-কর্মীদের বাইরেও জামায়াতের এমন অসংখ্য শুভাকাঙ্খি রয়েছে, যারা ইসলামের মূলনীতি বিরোধী বিষয়গুলোর সাথে জামাতের সম্পৃক্ততাকে মেনে নিবে না। কারণ জামায়াতের প্রতি তাদের সহানুভূতি, মুলত ইসলামকে কেন্দ্র করে।
এসব বিষয় ছাড়াও আওয়ামি লীগ ও বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া জনগনের বড় একটা অংশ, যারা নতুন কিছুর প্রত্যাশা করে এবং দেশের পরিবর্তন চায়, তারাও জামায়াতের উপর ভরসা রাখতে পাবে না।
অন্যদিকে তির্যক মন্তব্যে প্রশ্ন-বিদ্ধ করার সুযোগ পেয়ে, জামায়াত বিরোধীরাও যৌথ প্রচারণা মেতে উঠবে এবং জনমতের উপর এর নিশ্চিত ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
দুই নৌকায় পা-রাখার মত ভুল বারবার করার কারণে, ইসলামের সাইনবোর্ড সাথে নিয়েও, জামায়াতে ইসলামী মুসলিম-জনগনের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা তেত্রিশ কোটি হিন্দুদেবতার মন রাখতে কোমর বেঁধে নেমেছে। তাদের এই কৌশল কতটা ফলপ্রসূ হবে তা কেবল সময় বলে দেবে। একটি মুসলিম দেশে মুসলমানদের ভোটে জামায়াত ছিট পায় মাত্র ২/৩টি, কখনো কি চিন্তা করে দেখেছি বিষয়টা? একই মুদ্রার এপিট-ওপিট আওয়ামি লীগ ও বিএনপির শোষণ ও নিপিড়নে নিষপেশিত থেকেও, কেন মানুষ জামায়াতের উপর ভরসা রাখতে পারছে না?
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালাও শির্ক-মিশ্রিত-ঈমান গ্রহন করেন না। কালিমা তাইয়্যেবার প্রথম অংশের শিক্ষাও সেদিকেই ইঙ্গিত করে; লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু [কোন উপাস্য নেই, তিনি (এক আল্লাহ) ব্যতিত]। এই কালিমার প্রথম শর্তই হচ্ছে মিথ্যা উপাস্য ও শুভাকাঙ্খীদের থেকে, কল্যাণ প্রাপ্তির সব আশা ছেড়ে দেওয়া এবং কল্যাণ/ অকল্যাণের সকল চাবি কেবল এক আল্লাহর হতে বলে বিশ্বাস করা। অন্যথায় ঈমানের দাবী হবে কেবল কপটচারিতা। যেহেতু শির্ক-মিশ্রিত-ঈমানকে আল্লাহ পছন্দ করেন না, সেই কারণে তিনি সতর্ক করে বলেছেন:
وَ لَوۡ كَانُوۡا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ النَّبِیِّ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡهِ مَا اتَّخَذُوۡهُمۡ اَوۡلِیَآءَ وَ لٰكِنَّ كَثِیۡرًا مِّنۡهُمۡ فٰسِقُوۡنَ لَتَجِدَنَّ اَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَۃً لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الۡیَهُوۡدَ وَ الَّذِیۡنَ اَشۡرَكُوۡا ۚ وَ لَتَجِدَنَّ اَقۡرَبَهُمۡ مَّوَدَّۃً لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الَّذِیۡنَ قَالُوۡۤا اِنَّا نَصٰرٰی ؕ ذٰلِكَ بِاَنَّ مِنۡهُمۡ قِسِّیۡسِیۡنَ وَ رُهۡبَانًا وَّ اَنَّهُمۡ لَا یَسۡتَكۡبِرُوۡنَ
অর্থ: “তারা যদি আল্লাহ ও তাঁর নাবীকে বিশ্বাস করত এবং যা নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান আনতো, তবে (কাফিরদেরকে) বন্ধু মনে করতে পারত না, তাদের অধিকাংশই তো ফাসিক। (হে নবী) তুমি দেখবে, মুমিনদের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করার ক্ষেত্রে ইয়াহূদ ও মুশরিকরা সবচেয়ে কঠোর” (৫: ৮১-৮২)।
অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেছেন:
وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَىٰ شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ
অর্থ: আর যখন তারা ঈমানদারদের সাথে যুক্ত হয়, তখন বলে- আমরাও ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের বন্ধুদের (শয়তানদের) সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা আসলে তোমাদের দলের মানুষ; (মুসলমানদের সাথে) একটু উপহাস করি মাত্র। (২/১৪)
বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামীলীগ ও বিএনপির জন-বিচ্ছন্ন রাজনীতিতে ক্লান্ত। তারা একটি আদর্শভিত্তিক, সৎ ও আস্থার বিকল্প খুঁজছে। জামায়াতে ইসলামী যদি তাদের ঐতিহাসিক ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে, নিজেদের নীতি ও পদ্ধতির সংশোধন করে এবং ইসলামের মৌলিক নীতিমালার ওপর দৃঢ়তার কোন মডেল উপস্থাপন করতে পারে, তাহলে তারা মানুষের আস্থা ফিরে পেতে শুরু করবে।
আজ আওয়ামীলীগ পরিত্যক্ত ও অপসৃত, বিএনপির উপরেও মানুষের আস্থা নেই, এই অবস্থায় জামায়াত যদি সুযোগ কাজে লাগাতে না পারে এবং জনগনের প্রত্যাশা বুঝে তাদের পাশে না দাড়াতে পারে! তবে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি কোথায়!?



