জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

হিজাব: নারীর মর্যাদা রক্ষা ও পরিবারকে সুস্থ রাখার একটি মাধ্যম

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: হিজাব শুধু পরকালের সওয়াবের বিষয় নয়; এটি সমাজে নারীর উপস্থিতিকে নৈতিক কাঠামোর মধ্যে সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ রাখে। হিজাবের সীমা ভেঙে পড়লে নারীর মর্যাদা, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সুস্থতা হুমকির মুখে পড়ে এবং নৈতিক শৈথিল্য ও লাগামহীনতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমান ইরানসহ মুসলিম দেশগুলোতে বেপর্দা একটি “রাজনৈতিক হারাম” এবং শত্রুর সাংস্কৃতিক–রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

ইসলামের প্রজ্ঞাপূর্ণ বিধানগুলোর অন্যতম হলো হিজাব। এটি কেবল আখিরাতের প্রতিদানই নিশ্চিত করে না; বরং দুনিয়ার জীবনেও এর বহু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। হিজাব কখনোই নারীর সামাজিক উপস্থিতি নিষিদ্ধ করার অর্থ বহন করে না। বরং এর মূল লক্ষ্য হলো নৈতিক সীমার ভেতরে থেকে, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত ও ক্ষতিকর মেলামেশা এড়িয়ে, নারীর সামাজিক ভূমিকা সুশৃঙ্খল ও সম্মানজনকভাবে পরিচালনা করা। হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) এ ক্ষেত্রে এক অনন্য আদর্শ—তিনি সমাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেও শালীনতা ও লজ্জাশীলতার সর্বোচ্চ মান বজায় রেখেছেন।

হিজাবের পার্থিব ও বাস্তব সুফল বোঝার জন্য সমাজে বদহিজাবির বিস্তার কী ধরনের ক্ষতিকর পরিণতি ডেকে আনে, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

যখন কোনো সমাজে হিজাবের সীমা ভেঙে যায়, তখন প্রথম আঘাতটি আসে নারীর ওপর—আর তা হলো তার মানবিক মর্যাদার অবমূল্যায়ন। এমন পরিবেশে নারীকে তার প্রতিভা, যোগ্যতা ও সক্ষমতাসম্পন্ন একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে নয়; বরং ভোগবাদী মানসিকতার মানুষের চোখ, কান, মন ও কামনার বস্তু হিসেবে দেখা হয়। এই বস্তুবাদী ও ভাসাভাসা দৃষ্টিভঙ্গি নারীর বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও মানবিক সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশে গুরুতর বাধা সৃষ্টি করে।

এর পাশাপাশি আরেকটি ক্ষতি নারী, পরিবার এবং শেষ পর্যন্ত পুরো সমাজকে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান ও সামাজিক গবেষণা প্রমাণ করে—নারীর পোশাক যত বেশি অনাবৃত হয়, তত বেশি বেড়ে যায় দাম্পত্য বিশ্বাসঘাতকতা এবং তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে পরিবার ভেঙে পড়া, গর্ভপাত, অবৈধ বা অভিভাবকহীন শিশুর সংখ্যা, তথাকথিত ‘হোয়াইট ম্যারেজ’, এবং শিশুদের ভুল বা অসম্পূর্ণ লালন–পালন। মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কারণ একজন পুরুষ যখন ঘরের বাইরে নানাবিধ উস্কানিমূলক দৃশ্য ও আকর্ষণীয় উপস্থাপনার মুখোমুখি হয়, তখন তার পরিবার ও স্ত্রীর সঙ্গে মানসিক ও আবেগী বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষেত্র তৈরি হয়।

এই প্রেক্ষাপটে হিজাব একটি কার্যকর নৈতিক প্রতিবন্ধক হিসেবে নারীর নিরাপত্তা, পরিবারের স্থায়িত্ব এবং সমাজের সামগ্রিক সুস্থতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবশ্য এটাও স্বীকার্য যে হিজাব একাই এসব সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান নয়; তবে এর যথাযথ পালন এসব ক্ষতিকর প্রবণতা ও সামাজিক অবক্ষয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে সক্ষম।

এ প্রসঙ্গে কয়েক দিন আগে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ি বলেছেন, “পিতৃপরিচয়হীন শিশু, পারিবারিক সম্পর্কের অবক্ষয়, পরিবার কাঠামোর ধ্বংস, তরুণীদের শিকারকারী চক্র এবং যৌন লাগামহীনতার ক্রমবর্ধমান বিস্তার—এসবই আজকের পশ্চিমা সমাজে ‘স্বাধীনতা’র নামে সংঘটিত হচ্ছে। এটাই ঐসব দেশের পারিবারিক বাস্তবতা।” [ফার্স সন: ০৪/০৯/১২]

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—বর্তমানে ইরানে হিজাবের প্রশ্নটি একটি স্পষ্ট সাংস্কৃতিক–রাজনৈতিক অগ্রভাগে রূপ নিয়েছে। উপনিবেশবাদের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সময়ে সময়ে কৌশল পরিবর্তন করেছে। ফেরাউনদের যুগে তারা সামরিক শক্তি ও নিজেকে ঈশ্বর দাবি করার মাধ্যমে জাতিগুলোর মানবসম্পদ শোষণ করত। শিল্পবিপ্লবের পর এই পদ্ধতি বদলে যায়; তারা যুদ্ধ, হত্যাযজ্ঞ ও নানা অজুহাতের আড়ালে তেল, গ্যাস, হীরা ও লিথিয়ামের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে।

ভেনেজুয়েলায় তথাকথিত মাদকবিরোধী অভিযানের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী তৎপরতা কিংবা সন্ত্রাসবিরোধিতার নামে আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক উপস্থিতি—এসব তার সমসাময়িক উদাহরণ। ইতিহাসে কঙ্গোতে বেলজিয়ানদের, ক্যামেরুনে জার্মানদের এবং লিবিয়ায় ইতালীয়দের গণহত্যাও এই শোষণমূলক মানসিকতার নির্মম দলিল।

ইরানের ক্ষেত্রে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদীরা সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে সফল হতে পারেনি, সেখানে তারা নারী–পুরুষের সমান অধিকার ও স্বাধীনতার মতো আকর্ষণীয় কিন্তু বিভ্রান্তিকর স্লোগান ব্যবহার করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বার্তাপ্রেরণ অ্যাপ, সংবাদমাধ্যম ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় তারা এই জাতির সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় দুর্বল করার চেষ্টা করছে। কারণ তারা জানে—এই পরিচয় বিলুপ্ত হলে জনগণের আর জাতীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার প্রেরণা থাকবে না। তখন সামরিক আগ্রাসন বা অভ্যুত্থানের পথ সহজ হয়ে যাবে এবং বিপ্লব-পূর্ব যুগের মতো আবারও দেশের সম্পদ ও কৌশলগত অবস্থান লুণ্ঠনের সুযোগ তৈরি হবে। এই পরিকল্পনায় বেপর্দা একটি কেন্দ্রীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই ইসলামী বিপ্লবের নেতা একে “রাজনৈতিক হারাম” বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এই বাস্তবতার আলোকে আজ এই বিস্তৃত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় সচেতনতা, বোধ ও ঐক্য সব দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য অপরিহার্য। আশা করা যায়, মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও সহায়তায় ইরানের জনগণ এই পরীক্ষাতেও মর্যাদা ও দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তীর্ণ হবে।

~ হামেদ বেলালি পেজুহ

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button