বিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে ইসরাইলি থিংক-ট্যাঙ্কের নীল নকশা

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসরাইলের নিরাপত্তা বিষয়ক শীর্ষ থিংক-ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ (INSS)—যা তেলআবিবের অন্যতম প্রধান সিদ্ধান্ত-প্রস্তুত কেন্দ্র এবং সেনাবাহিনী ও মন্ত্রিসভার কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে—সম্প্রতি একটি নতুন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করা এবং লেবাননের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা অঙ্গনকে নতুনভাবে প্রকৌশল করার একটি তিন-ধাপের রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে।

এই কৌশলগত নথিটি প্রণয়ন করেছেন ওর্না মেজরাহি। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হিজবুল্লাহবিরোধী যুদ্ধের অর্জনসমূহ এবং সিরিয়ার দুর্বলতাকে ভিত্তি করে উত্তর সীমান্তে একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে, অভূতপূর্ব পর্যায়ে তেলআবিব ও বৈরুতের মধ্যে নতুন সম্পর্ক স্থাপনেরও প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

এই পরিকল্পনা সামরিক চাপ, রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনার একটি যৌথ কৌশলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মূল লক্ষ্য হচ্ছে—হিজবুল্লাহকে দুর্বল করা এবং লেবাননের পশ্চিমাপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে শক্তিশালী করা। প্রতিবেদনে সমালোচনা করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পরিকল্পনাগুলোকে, যা ইসরাইলি প্রস্তাবনার তুলনায় “অবাস্তব ও কঠোর” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মেজরাহির মতে, ইসরাইলি প্রস্তাবনা “বাস্তববাদী ও নমনীয়” এবং এটি তেলআবিবকে ধীরে ধীরে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে লেবাননের বাস্তবতা পরিবর্তনের সুযোগ করে দেবে।

তিন ধাপের পরিকল্পনা:
প্রথম ধাপ: দক্ষিণ লেবানন নিরস্ত্রকরণ—এর বিনিময়ে ইসরাইল পাঁচটি সীমান্ত-বিতর্কিত এলাকা থেকে সরে দাঁড়াবে। তবে এখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী (ইউনিফিল)-এর পরিবর্তে মার্কিন বাহিনী দায়িত্ব নেবে।

দ্বিতীয় ধাপ: উপত্যকা ও লেবানন-সিরিয়া সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে হিজবুল্লাহকে পুরোপুরি অপসারণ করা। এর বিনিময়ে লেবানন-ইসরাইল সীমান্ত বিরোধ মীমাংসা এবং সম্ভাব্যভাবে লেবানন-সিরিয়া সীমান্তের আনুষ্ঠানিক চিহ্নিতকরণ সম্পন্ন করা হবে।

চূড়ান্ত ধাপ: সমগ্র লেবাননে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করা। বিনিময়ে ইসরাইল তার সামরিক হামলা পুরোপুরি বন্ধ করবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে লেবাননের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করার প্রতিশ্রুতি দেবে।

শর্ত ও মেকানিজম:
এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে—সব ধাপে ইসরাইল নিজের সামরিক স্বাধীনতা বজায় রাখবে, যাতে হিজবুল্লাহর পুনর্গঠনের যেকোনো চেষ্টা প্রাথমিক পর্যায়েই দমন করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে লেবাননের সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করা এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেকোনো উপাদানকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়া। এর ফলে, ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বাহিনীর পরিবর্তে লেবাননের সেনাবাহিনীই সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেবে। ইউনিফিল বাহিনীকে কেবল সীমিত ও অস্থায়ী ম্যান্ডেটে রাখা হবে।

একই সঙ্গে, দক্ষিণ লেবাননের গ্রামগুলোতে পুনর্গঠন সহায়তা ও অর্থনৈতিক প্যাকেজ দেওয়া হবে শর্তসাপেক্ষে—অর্থাৎ, লেবানন হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণে যত অগ্রসর হবে, ততই সহায়তা বৃদ্ধি পাবে। এর মাধ্যমে জনসমর্থন সরকারের দিকে প্রবাহিত হবে এবং হিজবুল্লাহর সামাজিক ভিত্তি দুর্বল করার চেষ্টা করা হবে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে হিজবুল্লাহর ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে হবে। বিশেষভাবে, ইরানকে হিজবুল্লাহর প্রধান সমর্থক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে পরিকল্পনাগুলোতে পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয়েছে।

এই নথি ইসরাইলের হিজবুল্লাহবিরোধী সামরিক পরাজয়ের ফলশ্রুতিতে ভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে। সরাসরি ও স্বল্পস্থায়ী সংঘর্ষের পরিবর্তে তেলআবিব একটি বহুমাত্রিক ও ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধনীতিতে অগ্রসর হচ্ছে—যেখানে সামরিক চাপ, সুচিন্তিত ছাড় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা মিলিত হয়ে লেবাননে নতুন শক্তির ভারসাম্য তৈরি করার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button