ইতিহাসধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

‘হানজালা’ — যে শিশু ৫০ বছরেও বুড়িয়ে যায়নি!

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ৩০ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে সংহতি ও সহমর্মিতার দিন। এই উপলক্ষে ফিরে দেখা যাক ‘হানজালা’র কাহিনি—এক প্রতীকী কার্টুন চরিত্র, যে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি শিশুদের নিপীড়ন, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের কণ্ঠস্বর হয়ে আছে।

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ‘হানজালা’

শিশুদের কান্না আরশ কাঁপায়

শিশুদের দীর্ঘশ্বাস যখন আকাশে পৌঁছায়, নিশ্চয়ই তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা আরশকে কাঁপিয়ে তোলে, অশ্রুতে ভরিয়ে দেয় কায়নাতকে। শিশুরাই মানবতার সবচেয়ে কাছাকাছি প্রতিচ্ছবি—নিষ্পাপ, হিংসামুক্ত, জটিলতাহীন। তারা প্রতিদ্বন্দ্বী বানায় না, তাদের কান্না ও হাসি দুটোই খাঁটি। রাজনীতির কালিমায় তারা রঞ্জিত নয়। হয়তো এ কারণেই শিশুদের উপস্থিতিই এখনো সৃষ্টিকর্তার কাছে মানবজাতির টিকে থাকার আশা জাগায়।

একটি শিশুর কান্না, সে যে জাতি-ধর্ম বা ভাষারই হোক না কেন, অস্ত্রের মতোই শক্তিশালী—যা মানবিক হৃদয়কে ব্যথিত করে। ইতিহাস বারবার সেই কান্নার সাক্ষী হয়েছে: কখনো সোমালিয়ার ক্ষুধার্ত শিশুদের চোখে, কখনো ইয়েমেনি বালকদের মুখে, কখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভীত-সন্ত্রস্ত শিশুদের মাঝে। আর আজ, যুগের পর যুগ ধরে, ফিলিস্তিনের শোকার্ত ও নিপীড়িত শিশুদের চোখে সেই অশ্রু ঝরে পড়ছে নিরন্তর।

ক্ষুধার্ত, নির্বাসিত ও যন্ত্রণাগ্রস্ত এই শিশুদের আর্তনাদ আকাশে পৌঁছেছে। আল্লাহ যেন নিজেই তাদের নিঃসঙ্গতাকে আলিঙ্গন করেছেন। সমগ্র মহাকাশ তাদের জন্য এক দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে উঠেছে। সবাই জানে, একদিন না একদিন সেই কান্না বিস্ফোরিত হবে এবং তার প্রতিধ্বনি গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেবে।

 

এই কারণেই ইরানি ক্যালেন্ডারের ৯ই মেহর (৩০ সেপ্টেম্বর) ঘোষণা করা হয়েছে ফিলিস্তিনি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে সংহতি ও সহমর্মিতার দিন হিসেবে। এ উপলক্ষে ফিরে দেখা হচ্ছে সেই প্রতীকী চরিত্রের গল্প, যে বছরের পর বছর ধরে শিশুদের সংগ্রাম ও ন্যায়ের দাবির প্রতীক হয়ে আছে—প্রিয় কার্টুন চরিত্র হানজালা, যার নাম এখন স্বাধীনতাকামী আন্দোলনেরও অনুপ্রেরণা।

হানজালা’ কোথা থেকে এলো?

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হলো এক সরল চিত্র—ফাটা কাপড় পরা, খালি পায়ে এক শিশু; যে হাত পেছনে বাঁধা রেখে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ স্থির সামনের দিকে।

এ এক অতি সাধারণ কার্টুন। হয়তো কেউ ভাবতেও পারেনি যে এটি এত বছর টিকে থাকবে এবং শক্তিশালী প্রতীকে পরিণত হবে।

গুগলে যদি ‘হানজালা’ খোঁজা হয়, এই সংজ্ঞা দেখা যাবে: হানজালা” (অর্থ: তেতো কুমড়া) হচ্ছে ফিলিস্তিনি কার্টুনিস্ট নাজি আল-আলীর সৃষ্টি এক চরিত্র, যা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতীক এবং নির্বাসিতদের দুঃখময় ভাগ্যের প্রতিফলন।

প্রথমবার ‘হানজালা’র ছবি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে কুয়েতি পত্রিকা আস-সিয়াসাহ-এর পাতায়।

স্রষ্টার জীবন থেকে চরিত্রের জন্ম

‘হানজালা’কে সরল ভঙ্গিতে আঁকা হলেও তার টিকে থাকার রহস্য লুকিয়ে আছে চরিত্রটির আত্মায়—যে আত্মা নাজি আল-আলী তার নিজের শৈশব ও বেদনাময় অতীত থেকে এঁকেছেন।

নাজি আল-আলী জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনের আল-শাজারা গ্রামে। শৈশবে ইসরাইলি দখলদাররা গ্রাম ধ্বংস করলে তিনি পরিবারসহ লেবাননের আইন আল-হিলও শরণার্থী শিবিরে নির্বাসিত হন।

নিজের সৃষ্ট চরিত্র সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন: “তার নাম হানজালা। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, শুধুই সত্য দেখবে এবং বলবে। আমি তাকে সুন্দরভাবে আঁকিনি। তার চুল কাঁটার মতো খাড়া, সে মোটা নয়, সুখী নয়, শান্ত নয়। আরামপ্রিয় শিশুদের মতো নয়। সে খালি পায়ে—যেমন থাকে সব শরণার্থী শিশু। তার হাত পেছনে বাঁধা—এ যেন প্রতীক, যখন মার্কিন ধাঁচের সমাধানগুলো আমাদের সামনে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন আমাদের অস্বীকৃতির ভঙ্গি।”

নিজ জীবনে নাজি আল-আলী ৪০ হাজারেরও বেশি কার্টুন এঁকেছিলেন, অধিকাংশেই ছিল ‘হানজালা’। এভাবেই তিনি চরিত্রটিকে বৈশ্বিক প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত করেন।

কিন্তু তার সৃষ্টিকে মেনে নিতে পারেনি ইসরাইল। অবশেষে ১৯৮৭ সালে লন্ডনে মোসাদের হাতে আততায়ীর গুলিতে শহিদ হন নাজি আল-আলী। কিন্তু ‘হানজালা’ তখনো অমর। শহিদের রক্তেই যেন সে আরও দৃঢ় হয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে থাকে।

চিরকিশোর হানজালা

নাজি আল-আলী বলেছিলেন, ‘হানজালা’র বয়স ১০ বছর। কারণ তিনিও ঠিক ওই বয়সে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন।

কিন্তু আশ্চর্য হলো—‘হানজালা’ কখনো বড় হয়নি। স্রষ্টার মতে, মাতৃভূমির বাইরে মানুষ কখনো পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে পারে না।

এ কারণেই হয়তো এত বছর ধরে ‘হানজালা’ হৃদয়ে হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। কেউ কখনো তার মুখ দেখেনি। সে সবসময় পিছন ফিরেই থাকে—এটি তার নীরব প্রতিবাদ, বিশ্ববাসীর প্রতি ঘৃণা, যারা ফিলিস্তিনের ওপর অন্যায়কে চুপচাপ মেনে নিয়েছে।

নাজি আল-আলী বলেছিলেন: “হানজালা শপথ করেছে, ফিলিস্তিন মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সে ফিরে তাকাবে না। কারও চোখে তার মুখ ভেসে উঠবে না, তার হাসিও কেউ দেখবে না।”

ফিলিস্তিনের শিশুরা যেন আজও একেকজন ‘হানজালা’

আজও হানজালা’র পথচলা

১০ বছরের সেই শিশু আজ ৫৬ বছর ধরে দখলদারদের আতঙ্ক হয়ে আছে। তার অবয়ব, তার গল্প—সবই বিশ্বকে ফিলিস্তিনের দুঃখগাথা শুনিয়ে চলেছে।

কিন্তু শুধু কার্টুনেই তার যাত্রা সীমাবদ্ধ নয়। সময়ের সাথে সাথে ‘হানজালা’ হয়ে উঠেছে নানা আন্দোলন ও প্রচারণার প্রতীক। কোথাও দেখা যায় তাকে হ্যাকার সংগঠনের নাম হিসেবে, কোথাও গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী জাহাজে।

২০১৮ সালে ইতালির সিসিলি থেকে গাজায় পাঠানো এক ত্রাণজাহাজের নামও রাখা হয়েছিল হানজালা’—যা ১৮ বছরের অবরোধ ভাঙার আশায় যাত্রা শুরু করেছিল।

‘হানজালা’—শিশু, যে ৫০ বছরেও বুড়িয়ে যায়নি। সে মনে করিয়ে দেয়, ফিলিস্তিনি শিশুদের কান্না শুধু একটি জাতির নয়, সমগ্র মানবতার প্রতিধ্বনি।

তার পিছন ফিরিয়ে থাকা দেহ, খালি পা, বাঁধা হাত—সবই বিশ্বকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানায়। একদিন, যখন ফিলিস্তিন মুক্ত হবে, তখন প্রথমবারের মতো আমরা দেখতে পাব হানজালা’র মুখে হাসি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button