ইতিহাসকুরআনজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) ইমামতের প্রতিরক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমে অবস্থিত হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর পবিত্র মাজারে আয়োজিত মাহফিলের খতিব বলেন, ইমামত কোনো পার্শ্বিক বা গৌণ বিষয় নয়; এটি এমন এক মৌলিক সত্য, যার জন্য হযরত ফাতিমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা) নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, শেষ যুগের নানা বিভ্রান্তি ও কৃত্রিম সংশয় যেন ইমামত বিষয়ে আমাদের ঈমানকে দুর্বল না করে।

হুজ্জাতুল  ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ আহমদ হোসাইনি বলেন, ইমামত দ্বীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকিদাগত স্তম্ভ। তিনি গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যক্তির বক্তব্যে ইমামতের মর্যাদার প্রতি চরম অবমাননা লক্ষ্য করা যাচ্ছে— এমন ভাষা যা এমনকি আহলে বাইত (আ.)-এর প্রকাশ্য শত্রুরাও ব্যবহার করেনি। এ ধরনের বক্তব্য মুসলিম উম্মাহকে ইমামগণের পবিত্র দরবারে লজ্জিত করে।

হুজ্জাতুল  ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ আহমদ হোসাইনি

কুরআনের আলোকে ইমামত
তিনি বলেন, পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন রূপে বারোবার “ইমাম” এবং পাঁচবার “আইম্মা” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এই সংখ্যাগত তাৎপর্য শিয়া মনীষীদের দৃষ্টিতে বারোজন ইমাম ও পাঞ্জতান পাক (আ.)-এর প্রতি এক সূক্ষ্ম ইশারা বহন করে।

তিনি সূরা বাকারা’র ১২৪ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন—
وَإِذِ ابْتَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ ۖ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا ۖ قَالَ وَمِن ذُرِّيَّتِي ۖ قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইমামত একটি ঐশী দায়িত্ব, যা আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করেন। এটি কোনো সামাজিক নির্বাচন বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ফল নয়। একই সঙ্গে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, জুলুম ও পাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই মহান দায়িত্ব লাভের যোগ্য নয়।

তিনি আরও বলেন, সূরা ‘সা’-এ হযরত দাউদ (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন—
يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ
অতএব, ইমাম হলেন পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি ও খলিফা। যেমন নবুয়ত মানুষের দ্বারা নির্ধারিত নয়, তেমনি নবীর প্রকৃত উত্তরাধিকারীও মানুষের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল নন।

বুদ্ধিবৃত্তিক (আকলি) প্রমাণ
হুজ্জাতুল ইসলাম হোসাইনি বলেন, যুক্তিবুদ্ধিও নবীর জন্য উত্তরসূরি নির্ধারণের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে। কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে যে, সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার অধিকারী রাসূল (সা.) উম্মতের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা না দিয়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন? অথচ সাধারণ রাষ্ট্রপ্রধানরাও তাদের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিনিধি নির্ধারণ করে থাকেন।

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুয়তের সূচনালগ্ন থেকেই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ছিলেন। ইয়াওমুদ-দার উপলক্ষে তিনি ঘোষণা করেন—
هَذَا أَخِي وَوَصِيِّي وَخَلِيفَتِي فِيكُمْ
“এই ব্যক্তি আমার ভাই, আমার ওসিয়তপ্রাপ্ত এবং তোমাদের মাঝে আমার খলিফা।” [তাফসির তাবারি; তারিখে তাবারি; আল-কামিল ফিত তারিখ]

বারোজন ইমাম: কুরআন ও রেওয়াতের সাক্ষ্য
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একাধিক হাদিসে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর পরে বারোজন ইমাম হবেন—যেমন বনি ইসরাঈলের বারোজন নকীব ছিলেন।

কুরআনে এসেছে—
وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَيْ عَشَرَ نَقِيبًا
(সূরা আল-মায়িদা, ৫:১২)

এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে—
الأَئِمَّةُ بَعْدِي اثْنَا عَشَرَ، أَوَّلُهُمْ عَلِيٌّ وَآخِرُهُمُ الْمَهْدِيُّ
“আমার পরে ইমাম বারোজন; তাঁদের প্রথম আলী এবং শেষ মাহদী।” [কিফায়াতুল আসার; ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ]

কুরআনে নাম উল্লেখ না থাকার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা
তিনি বলেন, কুরআনে বারোজন ইমামের নাম সরাসরি উল্লেখ না থাকার বিষয়টি ইমামতের দুর্বলতা নয়। বরং এর পেছনে গভীর হিকমত রয়েছে। কুরআন নামের পরিবর্তে গুণ, দায়িত্ব ও অবস্থান তুলে ধরেছে। আহলে বাইতের মর্যাদা সম্পর্কে বহু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যেমন—

আয়াতে ওয়িলায়াত
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا
[সূরা মায়িদা, ৫:৫৫]

আয়াতে তাহারাত
إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ
[সূরা আহযাব, ৩৩:৩৩]

আয়াতে মাওয়াদ্দাত
قُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى
[সূরা শূরা, ৪২:২৩]

কবর ও আখিরাতে ইমামতের গুরুত্ব
তিনি বলেন, মৃত্যুর পর কবরে প্রথম প্রশ্নগুলোর একটি হবে—
مَنْ إِمَامُكَ؟
তোমার ইমাম কে?

অতএব, ইমামত বিষয়ে অসম্পূর্ণ বা বিকৃত বিশ্বাস পরকালে মারাত্মক পরিণতির কারণ হতে পারে। তিনি আলী ইবনে আবি হামজা বাতায়েনির ঘটনা উল্লেখ করেন, যিনি পার্থিব স্বার্থের কারণে ইমাম রেজা (আ.)-এর ইমামত অস্বীকার করে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হন।

তিনি আরও বলেন, ফাতিমা বিনতে আসাদ (রা.)-এর দাফনের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে তাঁর কবরে অবতরণ করেন এবং তাঁকে তালকিন দেন—
ابْنُكِ عَلِيٌّ إِمَامُكِ
“তোমার ইমাম তোমার পুত্র আলী।” [বিহারুল আনওয়ার]

ভাষণের শেষাংশে হুজ্জাতুল ইসলাম হোসাইনি বলেন, ইমামত এমন এক ঐশী সত্য, যার জন্য হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অতএব, বর্তমান যুগের সন্দেহ, অপপ্রচার ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রান্তির মুখে আমাদের কর্তব্য হলো—জ্ঞান, দলিল ও দৃঢ় ঈমানের মাধ্যমে ইমামতের এই মহান সত্যকে আঁকড়ে ধরা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button