ইতিহাসধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

হযরত জয়নাব (সা.আ.): আল্লাহর প্রদত্ত জ্ঞানের উজ্জ্বল প্রতিমা

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির :  মিহযরত জয়নাব (সা.আ.)—ইমাম আলী (আ.) ও ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর কন্যা, কারবালার বীরাঙ্গনা, “আকীলাতু বানী হাশিম”—শুধু শোক ও সাহসের প্রতীক নন; তিনি ছিলেন জ্ঞানে, বাগ্মিতায় ও নেতৃত্বে আহলে বাইতের দীপ্ত উত্তরাধিকার। তাঁর নাম ও উপাধিই যেন এক চাবি, যা উন্মোচন করে তাঁর গভীর চরিত্র, অবিচল ঈমান ও মানবতার প্রতি অশেষ দায়বদ্ধতা।

আহলে বাইত (আ.)-এর মহিমা কুরআনের আয়নায়

কুরআন মাজিদে নবীজির (সা.) পবিত্র পরিবার—আহলে বাইত (আ.)-এর মর্যাদা অসংখ্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে —
এবং মহান আয়াতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য — آیه تطهیر (আয়াতুত তাতহির), آیه مباهله (আয়াতুল মুবাহেলা), آیه مودت (আয়াতুল মাওয়াদ্দাহ), سوره هل‌أتی (সূরা হাল আতাঃ), آیه تبلیغ (আয়াতুত তাবলিগ) এবং মহান আয়াত:

إِنَّمَا وَلِیُّکُمُ اللهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِینَ آمَنُوا الَّذِینَ یُقِیمُونَ الصَّلَاه وَیُؤْتُونَ الزَّکاه وَهُمْ رَاکِعُونَ

এই সব আয়াত আহলে বাইত (আ.)-এর জ্ঞান, আত্মিকতা, নৈতিক মহিমা ও সমাজে নেতৃত্বের অধিকারকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।

 জয়নাব (সা.আ.): জ্ঞান ও বীরত্বের উত্তরসূরি

এই পবিত্র পরিবারের মাঝেই জন্ম নেন এমন এক মহীয়সী নারী, যিনি ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় রচনা করেন—হযরত যায়নাব (সা.)।
তিনি ৫ বা ৬ হিজরির ৫ই জমাদিউল আউয়াল তারিখে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম “জায়নাব” রাখা হয় নবী করিম (সা.)-এর মাধ্যমে, আল্লাহর আদেশে ও ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর বার্তায়।

যদিও নবী (সা.) ও মা ফাতিমা (সা.আ.)-এর সঙ্গে তাঁর সময় ছিল অল্প, তবুও তাঁদের আলো ও জ্ঞান তাঁর শৈশবেই চিন্তা ও চরিত্রের ভিত গড়ে তোলে।

 ইয়াজিদের স্বীকৃতি: “তারা জ্ঞান উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে”

ইয়াজিদ, আহলে বাইতের চরম শত্রু হয়েও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল:
«إنَّ هَؤُلاَء وَرَثُوا العِلمَ وَ الفَصَاحَه وَ زُقّوا العِلمَ زُقّاً»
অর্থাৎ, “এরা নবীর কাছ থেকে জ্ঞান ও বাকপটুতা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, এমনকি শিশুকাল থেকেই জ্ঞানের সাথে অভ্যস্ত।”

জয়নাব (সা.আ.)-এর জ্ঞানের মহিমা

হযরত জয়নাব (সা.আ.) সাতজন নিষ্পাপ ইমামের যুগ উপলব্ধি করেছেন। তাঁদের বাণী ও চরিত্র তাঁর জীবনে জ্ঞানের এক উজ্জ্বল রূপ ধারণ করে।
তাঁর জ্ঞান কেবল ধর্মীয় শিক্ষা নয়—বরং ছিল আত্মসচেতনতা, সামাজিক ন্যায়, সত্য প্রচার ও জালেমদের মুখোশ উন্মোচনের প্রতীক।

শিক্ষকবিহীন আলেমা

হযরত জয়নাব (সা.আ.)-কে “আলিমা বিদুনা মুআলিম (عالمه بدون معلم)” বলা হয়—অর্থাৎ এমন জ্ঞানী নারী, যিনি শিক্ষক ছাড়াই জ্ঞানে পারদর্শী।

কুরআন মাজিদে জ্ঞানের মর্যাদা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
«عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ‌یَعْلَمْ»

(আল-‘আলাক; আয়াত ৫)

তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।”

আরও বলা হয়েছে:
«یَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِینَ آمَنُوا مِنکُمْ وَالَّذِینَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ»

(আল-মুজাদিলা; আয়াত ১১)

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বহু গুণে উন্নীত করেন।”

রেওয়ায়াতভিত্তিক ব্যাখ্যায় এই “আলেমগণ”-এর সর্বোত্তম উদাহরণ হিসেবে আহলে বাইত (আ.)-কে বর্ণনা করা হয়েছে—যার অন্তর্ভুক্ত হযরত জয়নাব (সা.আ.)।

হযরত জয়নাব (সা.আ.)—নবী পরিবারের জ্ঞানের উত্তরাধিকারিণী, কারবালার বীরা, এবং নারী জাগরণের প্রতীক। তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রজ্ঞা, অধ্যবসায়, ত্যাগ ও আল্লাহনির্ভর জ্ঞানের এমন এক ইতিহাস, যা যুগে যুগে আলোকিত করেছে বিশ্বাসী হৃদয়গুলোকে।

ঈশ্বরপ্রদত্ত জ্ঞানের ধারক

হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জ্ঞানের উৎস ছিল ইলমে লাদুনি—অর্থাৎ সেই জ্ঞান, যা সরাসরি আল্লাহ তাআলা বান্দার অন্তরে দান করেন।
এ জ্ঞান কোনো শিক্ষক বা বাহ্যিক শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত নয়; এটি আত্মার পরিশুদ্ধি ও তাকওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নূর হিসেবে অন্তরে উদ্ভাসিত হয়।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তাঁর ফুফুকে সম্বোধন করে বলেন— আম্মা জান! আপনি এমন এক আলেমা, যিনি কোনো শিক্ষক ছাড়াই জ্ঞান অর্জন করেছেন; এমন এক প্রজ্ঞাবতী, যিনি কাউকে দিয়ে শিখে নন, বরং নিজে বুঝেছেন।”

এই ঐশী জ্ঞানের কারণেই তিনি শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলিতেও ছিলেন সুস্পষ্ট ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বিশেষত কারবালার পর তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব আহলে বাইতের ভাবাদর্শ রক্ষার অন্যতম স্তম্ভ হয়ে ওঠে।

আকীলাতু বানী হাশিম” — প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের প্রতীক

তাঁর উপাধি “عقیلة بنی‌هاشم” (আকীলাতু বানী হাশিম)—অর্থাৎ “বানী হাশিম গোত্রের প্রজ্ঞাবতী নারী”—প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ইবনে আব্বাস (রা.) প্রমুখ সাহাবারা। এই উপাধি শুধু বংশগৌরবের প্রতীক নয়; এটি নির্দেশ করে তাঁর চিন্তাশক্তি, নেতৃত্বগুণ, ধর্মীয় দায়িত্ববোধ ও সামাজিক প্রজ্ঞার গভীরতা। কারবালার পর বন্দিদশায়ও তিনি যে প্রজ্ঞা, স্থিতধীতা ও মর্যাদাপূর্ণ ভাষণে ইয়াযিদের দরবারে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন— তা ইতিহাসের পাতায় এক অবিনশ্বর প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।

মুহাদ্দিসা — নবী পরিবারের জ্ঞানের ধারক

হযরত জয়নাব (সা.আ.) ছিলেন এক নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসা (محدّثه) — নবী পরিবারের হাদিস বর্ণনাকারী। তিনি নবী করিম (সা.)-এর স্ত্রীগণ, তাঁর পিতা ইমাম আলী (আ.), মাতা ফাতিমা (আ.), ভাই ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)—সকলের কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।

রেওয়ায়েত ও হাদিসবিদরা বলেন, হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর পর হযরত জয়নাব (সা.আ.) হচ্ছেন সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য নারী রাওয়ি (বর্ণনাকারী)। তাঁর বর্ণিত হাদিসগুলোতে ফুটে ওঠে নবী পরিবারের আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও মানবিক নৈতিকতার গভীরতা।

 মুআল্লিমা — জ্ঞান ও চেতনার শিক্ষিকা

শিক্ষার দায়িত্ব শুধু মাদরাসায় নয়—কারবালার প্রান্তর ও বন্দিদশার মাঝেও হযরত জয়নাব (সা.আ.) শিক্ষা দিয়েছেন ধৈর্য, ঈমান ও ত্যাগের পাঠ।

তিনি ছিলেন “মুআল্লিমা (معلّمه)”—যিনি নারীদের শিক্ষা দিয়েছেন, সমাজকে চেতনা দিয়েছেন, সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
যখন নারীদের শিক্ষা সমাজে অস্বাভাবিক ছিল, তখন তিনি তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন নারী নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

মুফাসসিরা — কুরআনের আলোকিত ব্যাখ্যাকারী

হযরত জয়নাব (সা.আ.) কুরআনের তাফসির ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ছিলেন গভীর জ্ঞানসম্পন্ন। তাঁর ভাষণগুলো—বিশেষত কুফা ও শামে প্রদত্ত—কুরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। তিনি ছিলেন সেইসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত, যাদের সম্পর্কে কুরআন বলেছে—

«وَمَا یَعْلَمُ تَأْوِیلَهُ إِلَّا اللّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِی الْعِلْمِ»
কুরআনের গভীর অর্থ কেউ জানে না, আল্লাহ এবং যাঁরা জ্ঞানে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত, তারা ছাড়া।হযরত জয়নাব (সা.আ.) ছিলেন সেই রাসিখুন ফিল ইলম” — জ্ঞানে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম।

জ্ঞান, সাহস ও নেতৃত্বের চূড়ান্ত প্রতীক

হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জীবন এক পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয়—যেখানে একত্র হয়েছে জ্ঞান, সাহস, নেতৃত্ব, ধৈর্য ও আল্লাহপ্রেম। তিনি শুধু নবী পরিবারের উত্তরাধিকারিণী নন, ছিলেন ইতিহাসের স্রোতে নারী জাগরণের এক জ্যোতিষ্ক নক্ষত্র। তাঁর চরিত্র মুসলমানদের, বিশেষ করে নারীদের জন্য এক অনন্ত অনুপ্রেরণা—যিনি দেখিয়েছেন, জ্ঞান ও ঈমান মিলেই গড়ে তোলে সত্যিকার মানবতার প্রতিচ্ছবি।

হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক জিহাদ, তাঁর আধ্যাত্মিক সংগ্রামের মতোই, ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে আছে— এক আলেমা, এক শিক্ষক, এক ব্যাখ্যাকারী ও এক অদম্য বীরাঙ্গনা হিসেবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button