হযরত আবূ তালিব (আ.)-এর জীবনী:
পারিবারিক নাম আব্দে মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব। ঐতিহাসিকদের মধ্যে কারো মতে ইমরান এবং আবার কারো মতে শাইবাহ্। আর তাঁর উপনাম হচ্ছে আবু তালিব। আবূ মানে পিতা, তালিব হলেন জ্যেষ্ঠপুত্র তথা আবু তালিব মানে তালিবের পিতা। স্মর্তব্য যে, হযরত আবু তালিব (আঃ)-এর চার পুত্র ১. তালিব, ২. জাফর, ৩. আকীল, ৪. আলী। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের ৩৫ বছর আগে হযরত আবু তালিব পবিত্র মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিতা হযরত আব্দুল্লাহ (আ.)-এর আপন সহোদর ভাই। হযরত আব্দুল মুত্তালিব (আ.)-এর মৃত্যুর পর কুরাইশ গোত্র প্রধানের পদ ও দায়িত্ব হযরত আবু তালিব (আ.)-এর কাছে অর্পণ করা হয়। তিনি শিশু মহানবী (সা.)-এর ভরণপোষণের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও মমত্ববোধের কারণে মহানবী (সা.)-এর জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার্থে হযরত আবু তালিব (আ.) নিজের সকল শক্তি-সার্মথ্য ও প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি তাঁর নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহান নবী পাক (সা.)-এর পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারী ছিলেন। হযরত আবু তালিব (কু.ছে.আ.) জীবনে কখনো মূর্তি পূজা করেন নি। বরং তিনি ছিলেন মহান আল্লাহর সম্মানিত আউলিয়া-ই-কিরামের অন্তর্ভুক্ত। স্বীয় যুগে তিনি ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর সর্বশেষ ওয়াসী। সূরা বাকারার ১২৪ নং আয়াত অনুযায়ী হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতির শেষ বাস্তবায়নের দায়িত্বশীল ও ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি)।
ইমাম মূসা আল-কাযিম (আ.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “হযরত আবু তালিব (আ.) কি হযরত রাসূলুল্লাহর (সা.) ওপরও হুজ্জাত (মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হিদয়তের প্রামাণিক দলিল ও প্রমাণ) ছিলেন?” তিনি (কাযিম-আ.-) এ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “না! তবে তিনি ছিলেন ওয়াসিয়ত সমূহের আমানতদার এবং সেগুলো তিনি মহানবী (সা.)এর কাছে হস্তান্তর করেন।”
রাবী বলেন, “আমি তাঁকে (ইমাম কাযিম –আ.-) জিজ্ঞেস করলাম, “হুজ্জাত না হয়েও তিনি কীভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ওয়সিয়ত সমূহ পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন? হযরত কাযিম (আ.) তখন বললেন, “হযরত আবূ তালিব (আ.) যদি মহান আল্লাহর হুজ্জাত না হতেন তাহলে তাঁর কাছে ওয়সিয়ত সমূহ হস্তান্তর করাই হত না। অতঃপর আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে হযরত আবূ তালিব (আ.)-এর অবস্থা ও পরিণতি কেমন হয়েছিল?
ইমাম কাযিম (আ.) জবাবে বলেছিলেন, “হযরত আবূ তালিব (আ.) হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও পবিত্র কুরআনের প্রতি মুমিন (বিশ্বাসী) ছিলেন এবং ওয়সিয়ত সমূহ হযরত রাসূল (সা.)এর কাছে অর্পণ করে এ জগৎ থেকে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন।”
হযরত আবু তালিব (আ.) সর্বদা মহানবী (সা.)-এর সমর্থক, রক্ষাকারী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং নবী (সা.)-কে রক্ষা ও সাহায্য করার জন্য তিনি চেষ্টার ত্রুটি কখনো করেন নি। হযরত জাফার ইবনে আবী তালিব (রা.) এবং তাঁর সঙ্গী সাথীরা যারা হাবাশার (বর্তমান আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া) বাদশাহ নাজ্জাশীর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁদেরকে বাদশাহের কাছে অপমাণিত ও অপদস্থ করে তাঁদেরকে (বাদশাহের কাছ থেকে) বুঝে নিয়ে শাস্তিদানের জন্য হিজাজে মুশরিকদের কাছে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে আমর ইবনে আস মক্কার মুশরিকদের পক্ষ থেকে তৎকালীন হাবাশা গমন করলে হযরত আবূ তালিব (আ.) বাদশাহ নাজ্জাশীর কাছে প্রেরিত পত্রে কিছু কবিতা লিখে তাঁকে আশ্রয় গ্রহণকারীদের ব্যাপারে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন ও ইহসান (দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন) করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আর যখন কুরাইশরা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন হযরত আবূ তালিব (আ.) এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হন। ঐ সময় আবূ লাহাব অতি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিল এবং অন্যরাও তাকে বিশেষভাবে বিবেচনা ও মূল্যায়ন করত।
আর কুরাইশদের এ হত্যার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে হযরত আবূ তালিব (আ.) আবূ লাহাবের প্রতি সাহায্যের আহ্বান জানিয়ে হত্যার এ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ ও ব্যর্থ করে দিয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ অস্তিত্ব ও সত্তা দিয়ে হযরত আবূ তালিব (আ.)-এর অকুণ্ঠ চিত্তে এ সব আত্মত্যাগ, সহায়তা, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা অনুভব করেছিলেন এবং এ কারণেই মহান নবী (সা.) বিভিন্ন উপলক্ষ্যে স্বীয় পিতৃব্য হযরত আবূ তালিব (আ.)-এর প্রতি অত্যন্ত ভালোবাসা ও মহব্বত পোষণ করেছেন।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একদা হযরত আক্বীল ইবনে আবি তালিব (রা.) কে বলেছিলেন, আমি তোমাকে দু’দিক থেকে যথাঃ ১. আমার সাথে তোমার যে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে সেজন্য আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং ২. আমার পিতৃব্য আবূ তালিব তোমাকে ভালোবাসত বলে আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
এতসব আত্মত্যাগের কারণে মহানবী (সা.) তাঁর প্রশংসা করতেন এবং আবূ তালিবের জন্য মঙ্গল কামনা করতেন। যেমনঃ হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি আবূ তালিবের জন্য কোন্ জিনিস প্রত্যাশা করেন? তখন তিনি জবাবে বলেছিলেনঃ যে কল্যণ ও মঙ্গল আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি ঠিক সেটাই আমি তাঁর (হযরত আবূ তালিব) জন্য কামনা করি। মহানবীর (সা.) পবিত্র আহলুল বাইত (আ.) ও তাঁদের পিতামহ পিতৃপুরুষ হযরত আবূ তালিব (আ.) কে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং অগণিত হাদীসে তাঁর আধ্যাত্মিক মর্যাদা সমূহ এবং ঠিক একই ভাবে স্বীয় মহান পিতামহ পিতৃপুরুষ হযরত আবূ তালিব (আ.)এর প্রতি তাদের নিজেদের ভালোবাসার কথা বলেছেন। যেমন- বর্ণিত হয়েছে যে হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এক দিন কূফার রাহবায় উপবিষ্ট ছিলেন এবং জনগণ তাঁর চারপাশ ঘিরে রেখেছিল তখন এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হে আমীরুল মুমিনীন! কীভাবে এটা সম্ভব যে আপনি এমন এক স্থানে রয়েছেন যেখানে আপনাকে মহান আল্লাহ অধিষ্ঠিত করেছেন অথচ আপনার পিতা দোযখের আগুনে আযাব (শাস্তি) ভোগ করছেন?”
হযরত আলী (আ.) তাঁকে বললেন, মহান আল্লাহ তোমার মুখ ভেঙ্গে দিন! ঐ মহান আল্লাহর কসম! যিনি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে প্রেরণ করেছেন আমার পিতা যদি বিশ্বের সকল গোনাহগার পাপীদের জন্য শাফাআত করেন তাহলে মহান আল্লাহ তা কবূল করবেন। অথবা ইমাম বাক্বির (আ.) বলেছেন, “মহান আল্লাহর কসম! যখনই মানদণ্ডের একটি পাল্লায় হযরত আবূ তালিবের ঈমান এবং অপর পাল্লায় সকল মানুষের ঈমান রাখা হবে ঠিক তখনই হযরত আবূ তালিবের ঈমান সবার ঈমানের চেয়ে ভারী হবে।”
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ও একটি হাদীসে বলেছেন, যখন হযরত খাদীজা (সা.আ.) এবং হযরত আবূ তালিব (আ.) মৃত্যুবরণ করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত অবস্থায় তাঁদের (আ.) স্মরণ করে এই দুঃখ-কষ্ট ও শোকের ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে নিভৃতে প্রার্থনা করেন এবং মহান আল্লাহ হযরত জিব্রাঈল (আ.) এর মাধ্যমে তাঁকে ওহী করে জানালেন যে, মক্কা থেকে বের হয়ে যাও (হিজরত কর); কারণ মক্কায় তোমার আর কোন সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক নেই।
হযরত আবূ তালিবের (আ.)-এর ওফাত দিবস ২৬ রজব আর এ দিবসে তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাঁর মহৎ চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা করার সবচেয়ে উপযুক্ত সুযোগ ও সময় । হযরত আলী (আ.) থেকে স্বীয় পিতা ( হযরত আবূ তালিব) ও হযরত খাদিজার ওফাতের মুসিবতে একটি কবিতা বর্ণিত হয়েছেঃ হে আমার নয়ন যুগল! আবূ তালিব ও খাদিজা (আঃ) যারা ছিলেন অতুলণীয় তাঁদের জীবনবশানে অশ্রুপাত করতে থাক। আর এই অশ্রুকে তোমাদের জন্য মহান আল্লাহ মুবারক করে দিন।
মক্কাধিপতির সন্তানের (আবূ তালিব) হৃদয়বিদারক মৃত্যুতে এবং নারীদের নেত্রী যিনি সর্বাগ্রে নামায আদায়কারী মহিয়সী রমনী খাদিজা (সা.আ.)এর ওফাত উপলক্ষ্যে শোক জ্ঞাপন করছি। এ দু’জনের মৃত্যুতে ও তাঁদের হারানোর শোক ও বেদনার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করছি সমগ্র রজনী তাঁদের বিয়োগের হৃদয়বিদারক মুসিবতে হয়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন আমাদের দিবস ও রজনী। এ দু’জন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) দ্বীন ইসলামকে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে করেছেন সাহায্য ও সহায়তা করেছেন এবং যালেম ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ দিয়ে সংগ্রাম করেছেন।
সংগ্রহ ও অনুবাদ
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তবিদ ও গবেষক, মুহাম্মদ মুনীর হোসাইন খান