সুন্নি নাসিবি, ওহাবী ও সালাফি চিন্তাধারার ভিন্নতা: কুরআন, সুন্নাহ ও আহলে বাইতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির এক তুলনামূলক বিশ্লেষণ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: নাসেবি, ওয়াহাবী ও সালাফি— তিনটি ধারাই যদিও ইসলামের পরিসরের অন্তর্ভুক্ত, তবুও কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যায়, বিশেষ করে আহলে বাইত (আ.)-এর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নাসেবিরা প্রকাশ্যেই আহলে বাইত (আ.)-এর প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করে, কিন্তু ওয়াহাবী ও সালাফিদের অনেকেই যদিও শিয়াদের সাথে মতবিরোধ পোষণ করে, তবে সবসময় গালি বা অভিশাপের পর্যায়ে নেমে যায় না।
প্রশ্ন:সুন্নি নাসেবি, সুন্নি ওয়াহাবী ও সুন্নি সালাফিদের মধ্যে পার্থক্য ও মিল কোথায়?
উত্তর:নাসেবিয়াত বা আহলে বাইতের প্রতি দ্বেষের প্রবাহটি শুরু হয়েছিল ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের সূচনা পর্ব থেকেই। অপরদিকে ওয়াহাবী মতবাদ ইতিহাসে তুলনামূলক নতুন একটি ধারা।
নাসেবি কারা?
নাসেবিরা প্রকাশ্যে ইমাম আলী (আ.)-কে গালি দিত, তাঁর প্রতি ঘৃণা ও অভিশাপ বর্ষণ করত এবং তাঁকে অস্বীকার করা ছিল তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের অংশ। কিন্তু বর্তমানকালের বহু ওয়াহাবী ও সালাফি ব্যক্তি এমন কদর্য ভাষা ব্যবহার না করলেও, তারা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত ইমাম আলী (আ.)-এর বহু গুণাবলি ও মর্যাদা বা গুণবন্দনাকে অস্বীকার করে। তারা কখনও কখনও ইমাম আলী (আ.)-কে সম্মানসূচক ভাষায় স্মরণ করে বটে, কিন্তু বাস্তবে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের বৈরিতা চরম পর্যায়ে অবস্থান করে এবং সুযোগ পেলেই তারা শিয়াদের বিরুদ্ধে শত্রুতা প্রকাশ করে।
সালাফি কারা?
সালাফি বলতে সেই সব লোককে বোঝায়, যারা নিজেদেরকে পূর্বসূরি নেককার মুসলমানদের— অর্থাৎ সাহাবা ও তাবিঈনদের — অনুসারী বলে দাবি করে।
সপ্তম হিজরি শতকে ইবনে তাইমিয়া ‘সালাফিয়াত’-এর ধারনাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে ইসলামী বিশ্বে এক নতুন ধর্মতাত্ত্বিক সংঘাতের জন্ম দেন। তাঁর পর শিষ্য ইবনে কাইয়্যিম এই মতবাদকে আরও সুসংহত করতে ভূমিকা রাখেন।
‘সালফ’ শব্দটি আরবি ভাষায় ‘অতীত’ বা ‘পূর্ববর্তী’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ভাষাগতভাবে আমরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ‘সালফ’, আর আমাদের পূর্বসূরিরা আমাদের দৃষ্টিতে ‘খালফ’। ফলে এ শব্দটি আপেক্ষিক ও প্রজন্মভিত্তিক।
সাধারণ অর্থে ‘সালাফে সালেহিন’ বলতে বুঝানো হয় অতীতের সেই ধার্মিক ব্যক্তিদের, যাদের জীবনের আদর্শ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয়।
প্রথম যুগের সালাফ বলতে সাহাবা ও তাবিঈনদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার আবহ ছিল— কারণ তারা ইসলামের জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু ইবনে তাইমিয়া এই শব্দটিকে শুধু সম্মানার্থে নয়, বরং ধর্মীয় প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
সালাফিয়াতের মূল নবউদ্ভাবন
ইবনে তাইমিয়ার প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে বড় ‘বিধানগত নতুনত্ব’ ছিল— শরীয়তের উৎসকে কুরআন-হাদিসের বাইরে সাহাবা ও তাবিঈনদের বক্তব্য পর্যন্ত বিস্তৃত করা।
তিনি বলেন—সালাফ হলেন সেইসব লোক, যারা ইসলামের প্রথম তিন শতকে জীবনযাপন করেছেন; তারা সব গুণাবলির অধিকারী ছিলেন এবং প্রত্যেক সমস্যার সমাধানে তারাই অধিক যোগ্য।
আরও বলেন— সালাফদের বাণী ও কাজের উপরই ভরসা রাখো; কারণ তাদের পর কেউ এমন কিছু আনতে পারে না, যা তারা রেখে যায়নি।
সারসংক্ষেপে বলা যায়—
| ধারা | আহলে বাইত (আ.) সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি | মূল বৈশিষ্ট্য |
| নাসেবি | প্রকাশ্য শত্রুতা, গালি ও অভিশাপ | প্রথম যুগে উদ্ভূত |
| ওয়াহাবী | প্রকাশ্য গালি নয় সবসময়, তবে শিয়ার প্রতি বিদ্বেষ প্রবল | আধুনিক যুগে (মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের মাধ্যমে) |
| সালাফি | সাহাবা ও পূর্বসূরিদের অনুসরণের দাবি; ইমাম আলী (আ.)-কে মানলেও গুণাবলী অস্বীকার | ইবনে তাইমিয়া |
পাদটীকা:
১. ইবনে ফারস, আহমদ ইবনে ফারস, মু‘জাম মাকায়িস আল-লুগাহ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৯৫, কোম, মাকতাবাতুল ই’লাম আল-ইসলামি, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৪ হিজরি।
২. জাওহারি, ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ, আস-সিহাহ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৩৭৬, বৈরুত, দারুল ইলম লিল মালায়িন, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭৬ হিজরি।
৩. একই সূত্র।
৪. ইবন তাইমিয়া, আহমদ ইবনে আব্দুল হালিম, মাজমু‘ আল-ফাতাওয়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৫৭–১৫৮, মদিনা, মজমু’ আল-মালিক ফাহদ লি তিবাআতুল মুসহাফ আশ-শরীফ, ১৪১৬ হিজরি।



