ইতিহাসবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

সুদানের আল-ফাশির সংকটে বিদেশি পক্ষগুলোর ভূমিকা

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৩রা নভেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির:  সুদানের উত্তর দারফুর অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আল-ফাশির শহরটি র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর দখলে যাওয়ার পর, বিদেশি দেশগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা আফ্রিকার এই দেশের সংকটকে আরও ভয়াবহ ও জটিল করে তুলেছে।

সুদান: নীল নদের তীরে বিভক্ত এক রাষ্ট্র

আফ্রিকার শৃঙ্গ অঞ্চলে অবস্থিত নীল নদের নীল ও সাদা শাখা দ্বারা বিভক্ত সুবিশাল দেশ সুদান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দেশটি এক গভীর মানবিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়র মধ্যে পড়েছে।

২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে, জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী ও মোহাম্মদ হামদান দাগলু (হেমিদতি) নেতৃত্বাধীন র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)—এই দুই সামরিক শক্তির মধ্যে সংঘাত পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এই যুদ্ধে ২০,০০০-এরও বেশি মানুষ নিহত, ১৩ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত, এবং ৩০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয় অবস্থায় রয়েছে।

২০২৫ সালের ২৬ অক্টোবর তারিখে, উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশির শহর RSF বাহিনীর দখলে চলে যায়। এই পতন শুধু সামরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন নয়, বরং ২০০০-এর দশকের ভয়াবহ দারফুর গণহত্যার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কাকেও জোরালো করে তোলে।

অভ্যন্তরীণ সংঘাত নাকি বিদেশি হস্তক্ষেপের ফল?

সুদানের বর্তমান সংকট কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাত নয়; বরং এটি এক জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে বিদেশি হস্তক্ষেপ, গোত্রীয় বৈরিতা ও ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার—সব একসঙ্গে মিশে গেছে। বিশেষত সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর বিরুদ্ধে RSF বাহিনীকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক চাপ ও রাজনৈতিক প্রভাব খার্তুম সরকারের সার্বভৌমত্বকে আরও সংকটে ফেলেছে।

যুদ্ধের উৎপত্তি ও দারফুরে বিস্তার

এই গৃহযুদ্ধের শেকড় সুদানের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাকেন্দ্রের বিভাজনে নিহিত রয়েছে। ২০১৯ সালে ওমর আল-বশির সরকারের পতনের পর, পূর্বে একসঙ্গে থাকা আল-বুরহান ও হেমিদতি ক্ষমতা ও সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। RSF বাহিনী, যাদের উৎপত্তি দারফুরের জানজাউইদ মিলিশিয়া থেকে, অতীতে জাতিগত দমন ও নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত ছিল।

প্রথমে তারা রাজধানী খার্তুমে হামলা চালায়, পরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে—বিশেষ করে দারফুরে
দারফুর, যেখানে ২০০০-এর দশকে প্রায় ৩ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, আজ আবারও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।

আল-ফাশির, প্রায় ৮ লক্ষ মানুষের শহর, RSF-এর অবরোধে ছিল ১৮ মাস। ২০২৫ সালের অক্টোবরে শহরের পতন শুধু একটি সামরিক পরাজয় নয়, বরং এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সূচক। রাতের আঁধারে বেসামরিক এলাকায় আক্রমণ, নারী-শিশুর অপহরণ, বাড়িঘর ধ্বংস ও অগ্নিসংযোগ—সবই সেখানে দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়। হাজারো বাসিন্দা পালিয়ে তাওইলা শহরে আশ্রয় নেয়, প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে, যেখানে তারা গণহত্যা ও গণকবরের সাক্ষী হয়।

যুদ্ধাপরাধ ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ

আল-ফাশিরের পতন মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর পতনের প্রথম তিন দিনেই প্রায় ১,৫০০ বেসামরিক নাগরিক, যাদের অধিকাংশ মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর, হত্যার শিকার হয়। এটি স্পষ্টভাবে জাতিগত নিধনে উদাহরণ।

ছয়জন চিকিৎসাকর্মী অপহৃত হন এবং মুক্তিপণ দাবি করা হয়, যার ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।
হাসপাতালগুলোকে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয় এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম লুট করা হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় (OHCHR) এ পর্যন্ত গণহত্যা, নারীদের উপর সংগঠিত ধর্ষণ ও গোত্রীয় সহিংসতার নথি সংগ্রহ করেছে। এই ঘটনাগুলো দেশব্যাপী জাতিগত উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং মানবিক বিপর্যয়কে আরও তীব্র করেছে!
সুদান সরকার এইসব কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।

বিদেশি সহায়তার ভূমিকা

RSF বাহিনীর পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূমিকা সবচেয়ে বিতর্কিত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউএই RSF-কে সাঁজোয়া যান, হালকা অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ইউএই-এর এই সমর্থনের পেছনে রয়েছে দারফুরের স্বর্ণখনির নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং সোয়াকিন বন্দরের উপর কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা। এই বিদেশি সহায়তা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধে দায়বদ্ধতা প্রশ্নে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

মানবিক বিপর্যয়: পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী,

  • ৩০ মিলিয়ন মানুষ এখনো মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল,

  • ২৫ মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক খাদ্যসংকটে ভুগছে,

  • এবং ১৩ মিলিয়ন মানুষ দেশান্তরিত হয়েছে।

অসংখ্য শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে চাদ, মিসর ও ইথিওপিয়া-তে। দারফুরে প্রায় ২.৫ লাখ মানুষ অবরুদ্ধ, যারা খাদ্য, ওষুধ ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত অবস্থায় রয়েছে। RSF বাহিনী মানবিক সহায়তা আটকে দিয়ে অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দারফুরে চলছে জনবিন্যাস পরিবর্তন (demographic cleansing)—যার প্রভাব ভবিষ্যতের সামাজিক ও জাতিগত ভারসাম্যে ভয়াবহ হতে পারে।

অভ্যন্তরীণ পক্ষসমূহ

এই যুদ্ধে মূলত দুটি শক্তি মুখোমুখি:
১️. সুদানের জাতীয় সেনাবাহিনী, নেতৃত্বে জেনারেল আল-বুরহান, যারা দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে সক্রিয় এবং “জাতীয় মর্যাদা রক্ষা”-কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
২️. RSF বাহিনী, যারা বিদেশি সহায়তায় পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।

এ ছাড়া ইসলামপন্থী সংগঠন, স্থানীয় জনপ্রতিরক্ষা কমিটি ও বেসামরিক নাগরিক সংগঠনগুলোও সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখছে। এই কমিটিগুলো সীমিত সম্পদ নিয়েও নাগরিক সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সামরিক-বেসামরিক জোট দেশের পুনর্গঠনে মুখ্য হতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে সমন্বয় ও ঐক্য এখনো ভঙ্গুর।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা

বিলম্বিত হলেও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এখন দৃশ্যমান। জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহিংসতার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র RSF কমান্ডারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং জাতিসংঘ মহাসচিব অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। অঞ্চলীয় প্রভাবশালী দেশগুলো সেনাবাহিনী ও RSF-এর মধ্যে মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা শুরু করেছে।

তৃণমূল পর্যায়ে আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও জনমতও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে, আন্তর্জাতিক সাহায্য এখনো প্রকৃত চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। ফলে মানবিক পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

শান্তির সম্ভাবনা ও করণীয় পথ

সুদানে শান্তির সম্ভাবনা এখনো আছে, তবে তা অত্যন্ত নাজুক ও অনিশ্চিত।
শান্তির জন্য তিনটি প্রধান পথ প্রস্তাব করা হয়েছে:

সামরিক-নিরাপত্তা ভিত্তিক পথ: অস্ত্রবিরতি, RSF-কে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন।
রাজনৈতিক-বেসামরিক পথ: জাতীয় সংলাপ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং অবাধ নির্বাচন আয়োজন।
মানবিক-সামাজিক পথ: জাতীয় পুনর্মিলন, পুনর্গঠন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।

এই পথগুলোর সাফল্যের জন্য প্রয়োজন—

  • পারস্পরিক স্বীকৃতি ও বিশ্বাস,

  • বিদেশি হস্তক্ষেপের নিরসন,

  • অরাজনৈতিক পক্ষগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ,

  • এবং প্রতিশোধমূলক কার্যক্রম রোধে বিচারব্যবস্থা সক্রিয়করণ।

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা এবং একটি সংক্রমণকালীন সংসদ গঠন সরকারকে পুনরায় বৈধতা দিতে পারে। তবে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিভাজন, RSF-এর নৃশংসতা এবং বহিরাগত চাপ—এই তিনটি উপাদান এখনো শান্তির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আল-ফাশিরের পতন, RSF বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে সুদানের পরিস্থিতিকে এক বহুমাত্রিক ও গভীর সংকটে রূপ দিয়েছে। তবু জনগণের প্রতিরোধ, সেনাবাহিনীর প্রতি জনসমর্থন, এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রচেষ্টা দেশটির পুনর্গঠন ও স্থিতিশীলতার পথে আশার আলো জাগায়।

সুদানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনটি বিষয়ের ওপর:

  • জাতীয় ঐক্য ও পুনর্মিলন,

  • ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা,

  • এবং বিদেশি হস্তক্ষেপ সীমিত করা।

অভ্যন্তরীণ সংকটের পেছনে একাধিক বিদেশি স্বার্থ কাজ করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত গোপনে RSF-এর প্রধান সরবরাহকারী, স্বর্ণ চোরাচালান ও আধুনিক অস্ত্র প্রেরণের মাধ্যমে যুদ্ধকে জ্বালানি জুগিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নিরপেক্ষতার দাবি করলেও, আফ্রিকার শৃঙ্গ অঞ্চলে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ও সামরিক ঘাঁটির মাধ্যমে পরোক্ষ সহায়তা প্রদান করছে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, স্বর্ণ বাণিজ্য অব্যাহত রেখে এবং নীরব থেকে, এই সংঘাতে অপ্রত্যক্ষ সহযোগী হয়ে উঠেছে।

যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার লক্ষ্যে গঠিত “চতুষ্টয় উদ্যোগ (Quartet Initiative)”—এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ফলাফল দিতে পারেনি। ফলে, সুদানের ভবিষ্যৎ এখনো ঝুলে আছে অনিশ্চয়তার কাঁটায়, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ভর করছে দেশটির জনগণের ঐক্য, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার, এবং বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধের ওপর।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button