সিরিয়ায় আলাভী সম্প্রদায়ের উপর জোলানি সরকারের হত্যাকাণ্ড চলমান
সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং সন্ত্রাসী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির ব্যাপক আক্রমণ পঞ্চম দিন ধরে অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
তাসনিম নিউজ এজেন্সির বরাতে মিডিয়া মিহিরের প্রতিবেদনঃ আহমদ আল-শারা’র (জোলানি) নেতৃত্বে সিরিয়ার নতুন সরকার কর্তৃক সিরিয়ার ভূমধ্য সাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক আক্রমণ শুরু হওয়ার পঞ্চম দিন পেরিয়ে গেছে। জোলানি ইতিপূর্বে আল-নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা)’র নেতা ছিল। দামেস্ক সরকারের দাবি অনুযায়ী এই আক্রমণ পূর্ববর্তী সরকার (বাশার আল-আসাদ)-এর অবশিষ্ট সদস্যদের দ্বারা, বিশেষত সামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য করা হয়েছে। তবে এই আক্রমণের ফলাফল ছিল শত শত বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু। লন্ডনভিত্তিক সিরিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, যা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ার যুদ্ধ ও সংঘাতের সময় সরকারবিরোধী প্রচার মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে, তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে লাতাকিয়া এবং তারতুস প্রদেশে ১,০১৪ জন নিহত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে এই অঞ্চলে জোলানি সরকারের সমর্থিত সদস্যদের ব্যাপক আক্রমণ চলছে। সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত ওয়েবসাইট ‘এনাব বালাদি’, যা বাশার আল-আসাদের শাসনামলে বিরোধী প্রচার মাধ্যম হিসাবে কাজ করত-দাবি করেছে যে গত চার দিনের সংঘর্ষে মোট ৩১১জন বেসামরিক নাগরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা নেটওয়ার্ক, যা সাম্প্রতিক সময়ে জোলানি সরকারের পক্ষের বক্তব্য প্রচার করে চলেছে, একটি নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করেছে যে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ২৩১জন সশস্ত্র সদস্য এবং সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদস্যও নিহত হয়েছে। এই সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে আল-জাজিরাকে জোলানি সরকারের পক্ষ থেকে এই সংখ্যা প্রকাশ করতে বাধ্য করেছে, যাতে বিরোধী পক্ষ বা নিরপেক্ষ সংস্থাগুলির দেওয়া সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য বজায় থাকে।
সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল, যা ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরে অবস্থিত- একটি পার্বত্য এবং বনাঞ্চল। বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের পর, অনেক সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা সন্ত্রাসী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির হাত থেকে রক্ষা পেতে এই অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। অন্যদিকে, সিরিয়ার প্রাক্তন সেনাবাহিনীর অনেক নেতা ও কমান্ডার এই অঞ্চল থেকে এসেছিলেন। জোলানি সরকার দামেস্ক এবং দক্ষিণ সিরিয়ায় সাময়িকভাবে ক্ষমতা সুসংহত করার পর, এই অঞ্চল থেকে অবশিষ্ট সদস্যদের “নির্মূল” করার জন্য এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে এবং গত বৃহস্পতিবার থেকে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করেছে।
যাই হোক, সরকার প্রেরিত সদস্যদের কঠোর আচরণ এবং প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ, সেই সাথে প্রথম দিনেই বিরোধীদের সাথে সংঘর্ষে তাদের হতাহতের ঘটনা, দামেস্ক সরকারকে পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলি থেকে ব্যাপকভাবে সৈন্য ও সরঞ্জাম প্রেরণের আহ্বান জানাতে বাধ্য করেছে। এই সময়ে, সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি প্রতিশোধের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে এবং কিছু মসজিদের ইমাম ও খতিবদের দ্বারা উস্কানি দিয়ে এই অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে, যার ফলে হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যা শুরু হয়েছে।
সিরিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক রামি আবদুর রহমান এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন যে, নতুন সরকারের সমর্থিত সশস্ত্র সদস্যরা কেবল আলাভী সম্প্রদায়ের হওয়ার অভিযোগে শত শত নিরপরাধ মানুষকে রাস্তায় হত্যা করেছে। এই সদস্যরা গতকাল পর্যন্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিতে সক্রিয় ছিল এবং তাদের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী, যেমন আল-নুসরা ফ্রন্ট এবং তুর্কিস্তান পার্টি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তালিকায় ছিল। এখন তারা নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছে এবং তার ফলাফল হল এই ‘হত্যাকাণ্ড’ যা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। জোলানির সশস্ত্র সদস্যদের ধারণকৃত ও প্রকাশিত কিছু ভিডিওতে মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং রাস্তায় ফাঁসি দেওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে। একটি ভিডিওতে, সশস্ত্র সদস্যরা মানুষ হত্যার পর তাদের দেহের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পিষিয়ে দিয়েছে। আরেকটি ভিডিওতে, একজন সশস্ত্র সদস্য আক্রমণের পর ক্যামেরার দিকে বলেছে, “বানিয়া’ সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের একটি এলাকা যেখানে অর্ধেক বাসিন্দা হল সুন্নি এবং অর্ধেক আলাভী ছিল, কিন্তু এখন অর্ধেক সুন্নি এবং অর্ধেক ‘আলাউই’ সেখানে নেই।” এই সন্ত্রাসী তার নিজের গোষ্ঠীর প্রতি ইঙ্গিত করছে, যা ইদলিবে ছিল এবং আলাভীদের দমনের জন্য এই অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে।
কোন কোন সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলো কয়েকটি গ্রামের পুরুষ বাসিন্দাকে হত্যা করেছে, ফলে এই গ্রামগুলোর মহিলারা বিধবা হয়ে গেছেন। সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিন্দাও অব্যাহত রয়েছে। সিরিয়ার উপকূলে হত্যাকাণ্ডের পর জোলানির কাছে এসডি এফ নেতা আবদির অনুরোধ মাজলুম আবদি, যিনি আমেরিকা-সমর্থিত সিরিয়ান কুর্দিশ আধা-সামরিক বাহিনী“সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)” এর নেতা, সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান আহমদ আল-শারা (জুলানি)’র কাছে অনুরোধ করেছেন যে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হোক। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনও এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। সিরিয়ার উপকূলে হত্যাকাণ্ড নিয়ে জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্বেগ জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল বিকেলে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে, “সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে এক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর হৃদয় বিদারক এবং অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের দায়িত্ব এই হামলা ও অপরাধ বন্ধ করা।” ইরাকি রাজনীতিবিদ : সিরিয়ার উপকূলে যা ঘটছে তা অপরাধ ইরাকের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মিশান আল-জাবুরি সিরিয়ায় চলমান হত্যাকাণ্ড এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ঘটনাবলীর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এবং এক্স (টুইটার) এ তার অ্যাকাউন্টে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে বেসামরিক আলাভী নাগরিকদের ফাঁসি দেওয়ার দৃশ্য দেখে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন যে এটি একটি ভয়াবহ অপরাধ যা তাৎক্ষণিক নিন্দা ও তদন্তের দাবি রাখে। জাবুরি আরও সমালোচনা করেছেন যে ইরাকে কিছু লোক কেবল এই অপরাধের নিন্দা করেই থেমে গেছেন। সিরিয়ায় চলমান সহিংসতার প্রতি আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গতকাল রবিবার সিরিয়ায় “সংখ্যালঘু” সম্প্রদায়ের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছেন এবং সিরিয়ার অন্তর্বর্তী কালীন সরকার এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করার অনুরোধ করেছেন। রুবিও একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “সিরিয়ার অন্তর্বর্তী কালীন কর্তৃপক্ষের উচিত সিরিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এই গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করা।” লেবাননের আল-মায়াদিন নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন লেবাননের আল-মায়াদিন নেটওয়ার্ক জানিয়েছে যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি “আল-মাজিরাহ”, “বেইত জাব্রু” “দাইফা”, “ইয়াসিনস” এবং বরিয়ানস গ্রামে আক্রমণ চালিয়েছে। লাতাকিয়া প্রদেশের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত গ্রামগুলোতে হত্যাকাণ্ড কেন্দ্রীভূত ছিল, কিন্তু পরে এটি বানিয়াস এবং কারদাহা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
মিডিয়া মিহির/বিশ্ব/রাসেল আহমেদ