বিশ্বধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

সালাফি মতবাদের আভিধানিক ও পারিভাষিক বিশ্লেষণ

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: সালাফিবাদ’ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হলে এর সঙ্গে সম্পর্কিত মৌলিক ধারণাগুলোর দিকে আগে নজর দিতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে, “সালাফ” শব্দটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মুসলমানদের কাছে এটি একসময় ছিল আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিকভাবে সম্মানজনক একটি শব্দ; কিন্তু পরবর্তীকালে “সালাফিবাদ” নামের একটি মতবাদ এই শব্দটিকে নিজেদের ভাবধারার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে তার মৌলিক অর্থ ও মানে বিকৃত করেছে।

এই অধ্যায়ে আমরা “সালাফ” শব্দের প্রকৃত অর্থ ও সংশ্লিষ্ট ধারণাগুলো বিশ্লেষণ করব এবং দেখব কীভাবে সালাফিবাদের চিন্তাধারা বৃহত্তর ইসলামী বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে। নিঃসন্দেহে এই ধারণাগুলোর সঠিক উপলব্ধি সালাফিবাদ নামের চিন্তাপদ্ধতিকে গভীরভাবে বোঝার জন্য অপরিহার্য।

১. সালাফ

সালাফ” ধারণাটি সালাফিবাদী চিন্তায় কেন্দ্রীয় ও মূল উপাদান হিসেবে বিবেচিত। তাদের সমগ্র মতাদর্শ এই ধারণাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। ফলে সালাফি ও ওহাবী মতবাদ বুঝতে হলে ‘সালাফ’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ ও প্রেক্ষাপট জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১.১ —আভিধানিক শব্দার্থ

সালাফ” (سلف) শব্দের আক্ষরিক বা আভিধানিক অর্থ হলো “অতীত” বা “পূর্ববর্তী”।
আরবি ক্রিয়া “سَلَفَ – يَسلِفُ – سَلفاً” এর মূল অর্থ হলো আগে থাকা”, “অগ্রসর হওয়া” বা “পূর্বে যাওয়া”।[1]

ইবনে ফারেস বলেছেন, “সালাফ” শব্দের মূল ধাতুতে অগ্রগামিতা ও পূর্বত্বের ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে; সুতরাং সালাফ বলতে সেইসব মানুষকে বোঝায়, যারা অতীতে ছিলেন বা পূর্ববর্তী প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত।[2]

আরবি ভাষার বিশিষ্ট অভিধানকার আল-জাওহারি ‘সালাফ’ শব্দের ব্যাখ্যায় এমন এক শ্রেণির মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন, যাঁরা ইতিহাসের সূচনালগ্নে জীবনযাপন করেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শ্রদ্ধা ও অনুসরণের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।

আরবি ভাষার ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, “সালাফ” শব্দের মূল অর্থ হলো “মাজি”—অর্থাৎ অতীত। যেমন, “সালাফা আল-রাজুল” বলতে বোঝানো হয় এমন একজন, যিনি সময়ের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছেন। এই সংজ্ঞা অনুসারে, “সালাফ” একটি আপেক্ষিক ধারণা—প্রত্যেক সময়ের জন্য সালাফ হলো তার ভবিষ্যৎ সময়ের পূর্ববর্তী প্রজন্ম। এর বিপরীতে “খালাফ” হলো সেই প্রজন্ম, যারা পরে এসেছে। অন্যভাবে বললে, আমরা ভবিষ্যতের তুলনায় সালাফ, আর অতীতের তুলনায় খালাফ।

সাধারণ মুসলিম সমাজে “সালাফ” শব্দটি বহুল ব্যবহৃত, যার অর্থ প্রায়শই তার বাহ্যিক অর্থেই বোঝানো হয়—অতীতের মানুষ। কিন্তু যখন এর সঙ্গে “সালেহ” শব্দটি যুক্ত হয়, তখন তা হয়ে ওঠে “সালাফে সালেহীন”—অর্থাৎ সেই মহামানবেরা, যাঁদের জীবন, কর্ম ও আদর্শ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গর্ব ও অনুকরণের উৎস।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সালাফ শুধু অতীতের মানুষ নন; তাঁরা ইসলামি জ্ঞান, শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। তাঁদের কঠোর সাধনা ও নিষ্ঠা ইসলামের অখণ্ডতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নবী করিম (সা.)-এর যুগের নিকটবর্তী হওয়াও তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধির একটি অতিরিক্ত কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

তবে ইসলামী গ্রন্থাবলিতে এই শ্রদ্ধাভাজন স্মরণকে কখনোই এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি যে, সালাফদের কোনো বিশেষ ক্ষমতা থাকবে ধর্মীয় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে। তাঁদের বক্তব্য ও কর্ম নবী করিম (সা.)-এর সমতুল্য নয়, বরং তা গবেষণা ও মনোযোগের যোগ্য। তাঁদের মতামত পরবর্তী যুগের আলেমদের চিন্তায় প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু তা কখনোই চূড়ান্ত বিধান হিসেবে বিবেচিত হয়নি।

.সালাফ শব্দের পরিভাষাগত অর্থ

“সালাফ” শব্দের পরিভাষাগত অর্থের উৎপত্তি একটি নতুন চিন্তাধারার (বিদআত) ভিত্তিতে, যা সপ্তম হিজরি শতকে ইবনে তাইমিয়্যাহ প্রবর্তন করেন। তিনি পূর্ববর্তী আলেমদের (সালাফ) মত অনুসরণ না করে, “সালাফ” শব্দটির একটি নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন—যা ইসলামী চিন্তাবিদরা পূর্বে কখনও এই অর্থে ব্যবহার করেননি।

সালাফি চিন্তার একটি মৌলিক পরিবর্তন ইবনে তাইমিয়্যাহ এবং তাঁর অনুসারী সালাফিরা যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নতুন ধারণা (বিদআত) প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা হলো—ধর্মীয় বিধান নির্ধারণের উৎস বা “তাশরী’র উৎস” হিসেবে সাহাবা, তাবিইন এবং তাবি-তাবিইনের কার্যকলাপকে অন্তর্ভুক্ত করা।

ইবনে তাইমিয়্যাহর ভাষায়:

সালাফ হলেন সেই ব্যক্তিরা, যারা ইসলামের প্রথম তিন শতকে জীবনযাপন করেছেন, যাঁরা সকল গুণে পরিপূর্ণ ছিলেন এবং যেকোনো সমস্যার সমাধানে অন্যদের তুলনায় অধিক যোগ্য।”

এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী চিন্তায় একটি নতুন ধারা তৈরি করে, যেখানে কেবল কুরআন ও সুন্নাহ নয়, বরং প্রারম্ভিক মুসলিমদের আচরণও শরীয়াহর উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইবনে তাইমিয়্যাহ পরামর্শ দেন:

তোমরা সালাফদের কার্যকলাপ অনুসরণ করো। তাঁরা যা এনেছেন, তা যথেষ্ট এবং আর কেউ তাঁদের অজানা কিছু আনেনি।”

তিনি এতদূর পর্যন্ত বলেন যে, নবী করিম (সা.)-এর কিতাব ও সুন্নাহর পাশাপাশি, ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের মুসলিমদের রীতিনীতিও ধর্মীয় বিধানের উৎস হিসেবে গণ্য করা উচিত। তাঁর মতে:

আল্লাহর বিধান তিনটি উৎস থেকে প্রমাণিত হয়: আল্লাহর কিতাব, নবীর সুন্নাহ এবং প্রথম মুসলিমদের কার্যকলাপ। এই তিনের বাইরে কোনো উৎস থেকে শরীয়াহর বিধান প্রমাণ করা বৈধ নয়।”

তিনি আরও বলেন:

কোনো কাজকে ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করা বা তা পছন্দনীয় (মুস্তাহাব) হিসেবে গণ্য করার জন্য কেবল এই তিন উৎসই গ্রহণযোগ্য—আল্লাহর কিতাব, নবীর সুন্নাহ এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের রীতি। এর বাইরে সব কিছুই নতুন সৃষ্টি (বিদআত), যা গ্রহণযোগ্য নয়।

ইবনে তাইমিয়্যাহ শুধু নবী করিম (সা.)-এর অনুসরণকেই যথেষ্ট মনে করেননি; তিনি আহলে সুন্নাহর পথকে সম্পূর্ণরূপে সালাফদের অনুসরণ হিসেবেও বিবেচনা করেছেন। তাঁর শিষ্য ইবনে ক্বাইম এই চিন্তাধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান এবং একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দেন:

সালাফি কার্যকলাপ ও সাহাবাদের ফতোয়া অনুসরণের অনুমোদন” (ফি জাওয়াজ আল-ফাতওয়া বিল-আসার আস-সালাফিয়া ওয়াল-ফাতাওয়া আস-সাহাবিয়া)

এই চিন্তার ধারাবাহিকতা শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় ওহাবী মতবাদে। সেখানে বলা হয়:

আমরা বিশ্বাস করি, প্রথম তিন শতকের পর যেসব নতুন সৃষ্টি (বিদআত) এসেছে, তা সম্পূর্ণরূপে নিন্দনীয়। আমরা তা ভালো-মন্দ বা পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে বিচার করি না।”

তবে, এমনকি যারা বাহ্যিকভাবে সালাফি মতের ঘনিষ্ঠ বলে মনে হন, তাঁরাও সবসময় এই কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন না। উদাহরণস্বরূপ, আলেম শাতাবী এই মর্যাদা কেবল সাহাবাদের জন্য সংরক্ষিত রাখেন। তাঁর মতে:

সাহাবাদের সুন্নাহই হলো সেই আদর্শ, যা অনুসরণযোগ্য এবং যার দিকে প্রত্যাবর্তন করা উচিত।

[1] মুহাম্মাদ ইবনে মাকরাম ইবন মানযুর, লিসানুল আরব, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২০৬৮।

[2] আহমাদ ইবনে ফারেস গ্রন্থ: মাজমু মাকাইসুল লুগাহ, খণ্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৯৫।

লেখক: বাংলাদেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম ও মুসলেমিন ড. সাইয়্যেদ মাহদী আলীজাদেহ মুসাভী , বই, সালাফিবাদ ও ওয়াহাবিবাদ(সালাফিগারী ও ওহাবীইয়াত ।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button