জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোরআনিক উপায়

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: মানবজীবনের সৌন্দর্য নিহিত আছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও উত্তম প্রতিদানে। ইসলামের শিক্ষা বলে—একটি শুভেচ্ছা, একটি হাসি, একটি ছোট্ট উপহারও প্রতিদানে আরও সুন্দর কিছু পাওয়ার যোগ্য। হজরত আলী (আ.)-এর হিকমত ৬২ এ শিক্ষাটি আমাদের জীবনে শান্তি, সৌহার্দ্য ও মানবিক সম্পর্কের নবজাগরণ ঘটায়।

ইমাম আলী (আ.) নাহজুল বালাগা”-এর ৬২তম হিকমতে একটি গভীর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নীতি ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন—

إِذَا حُیِّیتَ بِتَحِیَّةٍ فَحَیِّ بِأَحْسَنَ مِنْهَا، وَإِذَا أُسْدِیَتْ إِلَیْکَ یَدٌ فَکَافِئْهَا بِمَا یُرْبِی عَلَیْهَا، وَالْفَضْلُ مَعَ ذَلِکَ لِلْبَادِئِ

অর্থাৎ, “যখন কেউ তোমাকে অভিবাদন জানায়, তুমি তার উত্তরে আরও সুন্দর অভিবাদন দাও। আর কেউ যদি তোমার প্রতি দয়া বা উপহার প্রদর্শন করে, তুমি তার প্রতিদানে আরও উত্তম কিছু দাও; তবে শ্রেষ্ঠত্ব তারই, যে নেকির সূচনা করেছে।

নৈতিক শিক্ষার গভীরতা
এই বাণীতে হজরত আলী (আ.) এক মৌলিক কুরআনিক নীতিকে স্মরণ করিয়েছেন—যে শুভেচ্ছা জানাবে, তার চেয়ে উত্তম শুভেচ্ছা ফিরিয়ে দাও (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৮৬)। ইসলামের নীতি স্পষ্ট: কোনো ভালো কাজ যেন অপ্রত্যুত্তর না থাকে। তা হোক একটি “সালাম”, একটি দোয়া, কিংবা একটি ক্ষুদ্র উপহার—উত্তরে তা আরও সুন্দরভাবে ফিরিয়ে দেওয়া উত্তম চরিত্রের পরিচায়ক।

যেমন কেউ যদি বলে—“আসসালামু আলাইকুম”, উত্তরে বলা উচিত—“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
আবার কেউ যদি ছোট একটি উপহার দেয়, আমাদের কর্তব্য হবে সুযোগমতো আরও উৎকৃষ্ট উপহার দিয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

এই মনোভাব সমাজে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও আস্থার বন্ধনকে দৃঢ় করে এবং এক প্রশান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করে।

ইমামদের জীবনে বাস্তব উদাহরণ
একটি ঘটনা বর্ণিত আছে—একবার ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে এক দাসী এসে একটি ফুল উপহার দিল। ইমাম (আঃ) সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তুমি আল্লাহর পথে মুক্ত।
সহচররা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তিনি তো শুধু একটি ফুল দিয়েছে, অথচ আপনি তাকে মুক্ত করে দিলেন?”
ইমাম (আ.) বললেন, এভাবেই আল্লাহ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন।
এরপর তিনি আয়াত তেলাওয়াত করলেন—

وَإِذَا حُیِّیتُم بِتَحِیَّةٍ فَحَیُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا
যখন তোমাদের অভিবাদন জানানো হয়, তোমরা তার চেয়ে উত্তমভাবে প্রতিউত্তর দাও। (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৮৬)

ইমাম ব্যাখ্যা করলেন—“সে আমাকে সম্মান জানিয়েছে, আর আমি তার সম্মানের উত্তরে সর্বোত্তম প্রতিদান দিয়েছি—তার স্বাধীনতা।

প্রথমে নেকি করার শ্রেষ্ঠত্ব
ইমাম আলী (আ.)-এর উক্তির শেষাংশে তিনি বলেন—“তবু শ্রেষ্ঠত্ব তারই, যে প্রথমে নেকি করে।”
কারণ, দ্বিতীয়জনের প্রতিক্রিয়া আসলে প্রতিদান; কিন্তু প্রথমজনের দান নিঃস্বার্থ, স্বতঃস্ফূর্ত ও নির্ভেজাল।

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাণীতে পাওয়া যায়—

সালামের সত্তরটি সওয়াব আছে—ঊনসত্তরটি তার জন্য, যে আগে সালাম দেয়; আর একটি সওয়াব তার জন্য, যে জবাব দেয়।

এ বাণী মানবিক বিনয়, উদারতা ও আত্মিক পরিপূর্ণতার এক অনুপম শিক্ষা দেয়।
ইসলামের নৈতিক সৌন্দর্য এখানেই—ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার বিনিময় সমাজে শান্তির তরঙ্গ ছড়িয়ে দেয়।
যে সমাজে “সালাম” শুরু হয় মুখে, আর প্রতিদানে হৃদয় উজ্জ্বল হয় নেকিতে, সেই সমাজেই আল্লাহর রহমত ও প্রশান্তি বিরাজ করে।

পদটিকা:

(১) নাহজুল বালাগা, হিকমত নং ৬২।
(২) বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৭৫, পৃষ্ঠা ১২০।
(৩) ইবনে মাইসামের “শারহে নাহজুল বালাগা”, হিকমত ৬২-এর অধীনে ব্যাখ্যা অংশ।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button