ইতিহাসকুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

সত্যিকারের পরিপূর্ণতা কি শুধুমাত্র ইসলামেই সীমাবদ্ধ?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়—এটি মানবজীবনের পূর্ণতা, যুক্তির আলো এবং চিরন্তন সত্যের প্রতীক। যুগে যুগে মানুষ সত্যের সন্ধানে নানা পথ বেছে নিয়েছে, কিন্তু সেই পথের শেষ ধাপে এসে যে আলো দেখা যায়, তা ইসলামেরই আলো। অন্যান্য ধর্মে কিছু সত্যের ছায়া থাকলেও, পূর্ণ সত্যের সূর্য উদিত হয় কেবল ইসলামেই। এর অলৌকিকতা, ঐতিহাসিকতা, সর্বাঙ্গীণতা এবং যুক্তিবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য—সব মিলিয়ে ইসলামই মানবতার জন্য চূড়ান্ত পথনির্দেশ।

প্রশ্ন: যদি ইসলামই সত্যের পূর্ণ প্রকাশ হয়, তবে কি অন্য ধর্মের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত একত্ব (তৌহিদ) ও আত্মিক পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে?

সংক্ষিপ্ত উত্তর: বিশ্বের নানা ধর্মে কিছু সত্যের আভাস থাকলেও, পূর্ণ সত্য—অর্থাৎ প্রকৃত তৌহিদ ও মানব জীবনের সর্বোচ্চ পরিপূর্ণতা—শুধুমাত্র ইসলামের মধ্যেই পাওয়া যায়। এর মূল কারণ হলো: অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থে প্রামাণিকতার অভাব, ঐতিহাসিক অসংগতি এবং যুক্তিবোধের সঙ্গে বিরোধ। পক্ষান্তরে, কুরআন অবিকৃত, যুক্তিসঙ্গত এবং মানববোধগম্য এক সর্বজনীন বার্তা।

 ধর্মবিশ্বের সীমাবদ্ধতা ও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব

বিশ্বের অন্যান্য ধর্মের সীমাবদ্ধতা এবং ইসলামের অনন্যতা বোঝার জন্য কয়েকটি দিক বিবেচনা করা জরুরি:

১. সব ধর্ম মিথ্যা নয়, কিন্তু সব সত্য নয়

আমরা একথা বলছি না যে অন্যান্য ধর্মের সব শিক্ষা মিথ্যা। বরং কিছু উপাদান সত্যের ছায়া বহন করে, কিন্তু পূর্ণ সত্যের আলো সেখানে অনুপস্থিত।

২. খ্রিষ্টধর্মের সীমাবদ্ধতা

বাইবেলের প্রামাণিকতা প্রশ্নবিদ্ধ: বাইবেল একক ও অবিকৃত গ্রন্থ নয়। বিভিন্ন সংস্করণে ভিন্নতা রয়েছে, এবং অনেক অংশের ঐতিহাসিক ভিত্তি দুর্বল।

যিশুর প্রচার ও ভাষাগত বিভ্রান্তি: যিশু (আ.) ছিলেন ইসরায়েলি, তাঁর ভাষা ছিল হিব্রু, এবং তিনি মূলত জেরুজালেম অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করেন। কিন্তু পরবর্তীতে গ্রীক ভাষাভাষী কিছু লোক তাঁর নামে ধর্ম প্রচার শুরু করেন এবং গ্রীক ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন—যা যিশুর প্রত্যক্ষ অনুসারীরা গ্রহণ করেননি।

মিথ্যাচার ও অলৌকিকতার অতিরঞ্জন: যেমন, মথিউ ইঞ্জিলে বলা হয়েছে—যিশুর জন্মের সময় আকাশে একটি তারা দেখা যায়, যা অনুসরণ করে জ্যোতিষীরা তাঁর ঘর পর্যন্ত পৌঁছান। এমন অলৌকিক বর্ণনা বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বিরোধপূর্ণ মৃত্যু ও ইঞ্জিল নির্বাচন: যিশুর মৃত্যুর বিষয়ে চারটি ভিন্ন বিবরণ রয়েছে। কিছু সংস্করণে বলা হয়েছে তিনি মরেননি। ৩০০ বছর পর কিছু ধর্মগুরু মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন কোন চারটি ইঞ্জিল গ্রহণযোগ্য হবে।

যুক্তিবিরোধী বিশ্বাস: যেমন, “ঈশ্বর পুত্ররূপে অবতীর্ণ হয়ে মানুষের পাপ নিজের উপর গ্রহণ করেছেন”—এটি যুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

৩. ইহুদি ধর্মের সীমাবদ্ধতা

তওরাতের তিন সংস্করণ: ১. হিব্রু সংস্করণ (ইহুদি ও প্রোটেস্ট্যান্টদের কাছে গ্রহণযোগ্য) ২. সামারি সংস্করণ (সামারি সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য) ৩. গ্রীক সংস্করণ (প্রোটেস্ট্যান্ট নয় এমন খ্রিষ্টানদের কাছে গ্রহণযোগ্য)

সামারি সংস্করণে সীমিত গ্রন্থ: তারা শুধু মূসা (আ.)-এর পাঁচটি বই এবং যোশু ও বিচারকদের গ্রন্থ গ্রহণ করে। বাকিগুলো তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

আল্লাহর অবমাননাকর উপস্থাপন: কিছু বর্ণনায় আল্লাহকে মানুষের মতো দেখানো হয়েছে—যিনি হাঁটেন, গান গাইছেন, এমনকি মিথ্যা বলেন ও প্রতারণা করেন। উদাহরণ: আদম ও হাওয়ার গাছ থেকে খাওয়ার পর মৃত্যু হয়নি, বরং তারা ভালো-মন্দের জ্ঞান অর্জন করে।

আল্লাহ ও ইয়াকুবের সংঘর্ষের গল্প: তওরাতে এমন গল্প আছে যেখানে আল্লাহ ও ইয়াকুবের মধ্যে কুস্তির মতো সংঘর্ষের বর্ণনা রয়েছে—যা মানবিক বুদ্ধির সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

 ইসলাম: পূর্ণ সত্যের আলোকবর্তিকা

ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যার মূল গ্রন্থ কুরআন অবিকৃত, ঐতিহাসিকভাবে সংরক্ষিত এবং যুক্তিবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলামের তৌহিদ—এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস—মানব জীবনের সর্বোচ্চ আত্মিক ও নৈতিক পরিপূর্ণতার পথ।

ইসলামের সত্যতা শ্রেষ্ঠত্বের কারণসমূহ

ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়—এটি মানবজীবনের পূর্ণতা, যুক্তির আলো, এবং চিরন্তন সত্যের প্রতীক। এর শ্রেষ্ঠত্ব ও সত্যতা বোঝার জন্য নিচের কয়েকটি দিক গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন:

. কোরআন: চিরজীবী অলৌকিকতা

ইসলামের প্রধান অলৌকিক নিদর্শন হলো কোরআন—যা কোনো জাদু নয়, বরং যুক্তি, জ্ঞান ও হৃদয়ের ভাষায় প্রকাশিত এক মহাগ্রন্থ। পূর্ববর্তী নবীদের অলৌকিকতা ছিল সময়সীমাবদ্ধ ও ইন্দ্রিয়নির্ভর, কিন্তু কোরআন এমন এক অলৌকিকতা যা নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর অনুপস্থিতিতেও জীবন্ত এবং চিরকালীনভাবে প্রাসঙ্গিক।

আল্লাহ নিজেই এই গ্রন্থের চিরন্তনতা ঘোষণা করেছেন:

যদি তোমরা আমার বান্দার প্রতি নাজিল করা কোরআন নিয়ে সন্দেহ পোষণ কর, তবে এর সমতুল্য একটি সূরা আনো।” (সূরা বাকারা: ২৩)

.  কোরআনের অবিকৃততা সংরক্ষণ

ইতিহাসে বহু ধর্মগ্রন্থ বিকৃত হয়েছে, কিন্তু কোরআন আজও অবিকৃত। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন:

নিশ্চয়ই আমরাই কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজর: ৯)

নবী মুহাম্মদ (সা.) কোরআনের সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন:

১.কাতিবুল ওহীদের মাধ্যমে আয়াত লিখে সংরক্ষণ করা হতো।

২.সাহাবাদের উৎসাহিত করা হতো মুখস্থ করার জন্য—তাঁরা ছিলেন প্রথম হাফেজ।

৩.তাজবীদ ও সঠিক উচ্চারণ শেখানো হতো, যাতে পাঠে কোনো বিকৃতি না ঘটে।

এই পদ্ধতিগত যত্নই কোরআনকে বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছে।

.  নবী মুহাম্মাদ (সা.): শেষ নবী

ইসলাম স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে—মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর শেষ নবী। তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। (সূরা আহযাব: ৪০)

শেষ নবী হওয়া মানে, তাঁর বার্তা সর্বশেষ ও সর্বজনীন নির্দেশনা। অন্য ধর্মে এমন চূড়ান্ত ঘোষণা নেই। বরং তাদের ধর্মগ্রন্থে ইসলামি নবীর আগমন সম্পর্কে পূর্বাভাস রয়েছে—যা প্রমাণ করে, তাদের সময় ছিল সীমিত ও আপাতকালীন।

. ইসলামের সর্বাঙ্গীণতা

ইসলাম শুধু নামাজ-রোজার ধর্ম নয়—এটি ব্যক্তিগত, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, মানসিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি স্তরে পথনির্দেশ দেয়। এর শিক্ষা বিস্তৃত:

১- বিশ্বাস ও তৌহিদ

২- নৈতিকতা ও মানবিকতা

৩- পারিবারিক ও সামাজিক আচরণ

৪- আইন, অর্থনীতি, রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা

তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, অন্য ধর্মের শাস্ত্র এত বিস্তৃত ও প্রাঞ্জল নয়।

. ইসলামের প্রামাণিক ইতিহাস

ইসলাম একমাত্র ধর্ম যার ইতিহাস জীবন্ত ও প্রমাণভিত্তিক। নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর শৈশব থেকে শুরু করে প্রতিটি অধ্যায় বিস্তারিতভাবে সংরক্ষিত। অন্য ধর্মে এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুপস্থিত।

উপসংহার:

ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব কোনো ধর্মীয় গর্ব নয়, বরং এটি একটি বাস্তবতা—যা যুক্তি, ইতিহাস ও মানবিক চেতনার আলোকে প্রতিষ্ঠিত। কোরআনের অবিকৃততা, নবীর খাতমীয়ত, ইসলামের সর্বজনীন শিক্ষা এবং প্রামাণিক ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ইসলামই সেই ধর্ম যা মানুষকে প্রকৃত তৌহিদ, নৈতিকতা ও আত্মিক পরিপূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে সক্ষম। সত্যের সন্ধান যদি হয় আন্তরিক, তবে তার শেষ ঠিকানা ইসলাম ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

পাদটীকা

[১] শিরানি, আবুল হাসান, রাহে সা‘আদাত, পৃঃ ১৮৭–১৮৮, ১৯৭–২২১।

[২] বিস্তারিত জানতে দেখুন:

  • রাহে সা‘আদাত, লেখক: আল্লামা শিরানি
  • ইজহারুল হক, লেখক: ফাযিল হিন্দি
  • কোরআন ও অন্যান্য আসমানি গ্রন্থ, লেখক: আবদুল করীম হাশেমি নেজাদ

[৩] বাইবেল, যোহান ৩:১৬–১৭।

[৪] রাহে সা‘আদাত, পৃঃ ২০৬–২০৭।

[৫] তওরাত, সাফর পিদায়েশ, অধ্যায় ২ ও ৩।

[৬] একই গ্রন্থ, অধ্যায় ২১, আয়াত ২৪।

[৭] কোরআন, সূরা বাকারাহ ২৩।

[৮] কোরআন, সূরা হুজুরাত ৯।

[৯] রাহে সা‘আদাত, পৃঃ ২২, ২১৫, ২৪, ২৫।

[১০] কোরআন, সূরা আহযাব ৪০; সহীহ বুখারি, খণ্ড ৪, পৃঃ ২৫০।

[১১] রাহে সা‘আদাত, পৃঃ ২২৬–২৪১; বাইবেল, যোহান ২১:৪১।

[১২] মোতাহারী, মর্তজা, মজমুওআতে আসার, খণ্ড ১৬, পৃঃ ৪৪, তেহরান, সেদরা, ১৩৮১শ।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button