ধর্ম ও বিশ্বাসকুরআনজীবনযাপনবিশেষ সংবাদবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

শেষ যুগে যে তিনটি গোষ্ঠী বিপর্যস্ত হবে

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন| প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: হেদায়াত ও ওহি সংস্কৃতিতে “ইমামকে চেনার জ্ঞান” শুধুমাত্র একটি বিমূর্ত ধারণা নয়; এটি একজন বিশ্বাসীর বিশ্বাস ও আচরণের সুরক্ষার প্রধান ভিত্তি। নবী করিম (সা) এবং আহলে বাইতের অসংখ্য হাদিস এই সত্যের সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণকে চেনা ছাড়া, মানুষের জীবন যাপন যদি তা বাহ্যিক ইবাদাতের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়—তবুও জাহেলিয়াতের বিপদের মুখে থাকে।

এই জ্ঞান যেন এক আলো, যা পথকে বক্রপথ থেকে আলাদা করে এবং হৃদয়কে মিথ্যা প্রবাহ থেকে বিরত রাখে। এই জ্ঞানের আলোতে মানুষ নকল করা বা কৃত্রিম চিন্তাভাবনা ও আধ্যাত্মিকতার ফাঁদে পড়ে না এবং মিথ্যা দাবিকারীদের জালে ফাঁস হয় না। তাই, মাসুমদের হাদিস কেবল সঠিক ইমামকে পরিচয় করায় না, বরং এটি আমাদের বিশ্বাসকে সুরক্ষিত রাখে এবং বিচ্যুত চিন্তার বিরুদ্ধে সীমারেখা নির্ধারণ করে।

ইমাম হাসান আসকরের বাণী ও শেষ যুগের সংকট

ইমাম হাসান আসকরি (আঃ) তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে, আহলে বাইতের হেদায়াতমূলক পরম্পরার ধারায়, উম্মতকে অজ্ঞতা এবং মিথ্যা প্রবাহের ফাঁদ থেকে রক্ষা করার জন্য স্পষ্টভাবে তাঁর পরবর্তী হুজ্জাত বা ইমামের পরিচয় দেন এবং গায়েবের সময়ের সংবেদনশীল পরিস্থিতির একটি সুনির্দিষ্ট চিত্র তুলে ধরেন।

শেখ সোদুক তাঁর কামালুদ্দীন গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন উসমান উমরীর বর্ণনা তুলে ধরেছেন:

আমি ইমাম হাসান আসকরের কাছে উপস্থিত থাকাকালীন তাঁর পূর্বপুরুষদের বর্ণিত একটি হাদিস সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম:
“পৃথিবী কিয়ামতের দিন পর্যন্ত খোদার হুজ্জতবিহীন থাকবে না, এবং যে মারা যায় এবং তাঁর সময়ের ইমামকে চেনে না, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু মরণ করেছে।”
ইমাম বললেন:
“এটি সত্য, যেমন দিনের সত্য।”
এরপর প্রশ্ন করা হলো: “হে রসুলুল্লাহর পুত্র! আপনার পরে হুজ্জত ও ইমাম কে?”
ইমাম বললেন:
“আমার পুত্র মুহাম্মদ, তিনি আমার পরে ইমাম এবং হুজ্জত। যে মারা যায় এবং তাঁকে চেনে না, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু মরণ করেছে। সতর্ক থাক, তাঁর একটি গায়েবের সময় হবে, যেখানে অজ্ঞরা হতবুদ্ধি হবে, মিথ্যাবাদী ধ্বংস হবে এবং সময় নির্ধারণকারীরা মিথ্যা বলবে।”
(سُئِلَ أَبُو مُحَمَّدٍ الْحَسَنُ بْنُ عَلِیٍّ …)

এই হাদিস শিয়াদের জন্য এক প্রকার পথনির্দেশিকা এবং বিশ্বাসের কঠিন পরীক্ষার সময়ে উত্তরণের নির্দেশ।

ইমাম হাসান আসকরের উত্তর দুইটি অংশে বিভক্ত:

১. পরবর্তী ইমামের পরিচয় ও জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে মুক্তির শর্ত

ইমাম স্পষ্টভাবে বলেন:

“আমার পুত্র মুহাম্মদ (ইমাম মাহদী আঃ) আমার পরে ইমাম এবং হুজ্জত। যে মারা যায় এবং তাঁকে চেনে না, তার মৃত্যু জাহেলিয়াতের মতো।”

অর্থাৎ, ইমামকে চেনা কেবল একটি গুণ নয়, বরং বিশ্বাসী জীবনের মানদণ্ড। যেমন নবী ছাড়া জীবন জাহেলিয়াতের অন্ধকারে ছিল, তেমনি মাসুম ইমামকে না চেনা জীবনও দিকহীনতা এবং জাহেলিয়াতের বিকৃতিতে পতিত করে।

২. গায়েবের সময়ের বৈশিষ্ট্য

ইমাম সতর্ক করেন যে, তাঁর জন্য একটি গায়েবের সময় হবে, যেখানে:

  • “অজ্ঞরা হতবুদ্ধি হবে” – কারণ তাদের ভিত্তি দৃঢ় নয়। (یَحَارُ فِیهَا الْجَاهِلُونَ)
  • “মিথ্যাবাদী ধ্বংস হবে” – কারণ তারা অন্যদের মিথ্যা দেখানোর চেষ্টা করে। (یَهْلِكُ فِیهَا الْمُبْطِلُونَ)
  • “সময় নির্ধারণকারীরা মিথ্যা বলবে” – কারণ আবির্ভাবের সময় শুধুই আল্লাহর রহস্য। (یَكْذِبُ فِیهَا الْوَقَّاتُون‏)

গায়েবের সময়ে অজ্ঞতার কারণে বিভ্রান্তি, একেবারেই সর্বাধিক প্রভাব ফেলে। অজ্ঞতা হল সঠিক জ্ঞান ও পরিচয়ের অভাব, যা কুরআন ও اهل-বাইতে বিপজ্জনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাস জুড়ে শত্রুরা মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সমাজকে বিকৃত পথে পরিচালিত করেছে। তাই অজ্ঞতাকে দূর করা মূল বিষয়, যা বিশ্বাস ও সমাজের নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যক।

মিথ্যাবাদী ও বিভ্রান্তদের বিপর্যয়

“وَیَهلِکُ فیها المُبطِلُون”

যে ব্যক্তিরা সচেতনভাবে সত্যকে বিকৃত করে বা বিশ্বাসীদের মনেতে সন্দেহ সৃষ্টিতে লিপ্ত, তারা ধ্বংসের মুখে পড়ে। ইমাম সাদিক (আঃ) বলেন:

“তিনি আমার পুত্র মূসার পুত্রদের মধ্যে পঞ্চম, যার একটি গায়েব থাকবে, যেখানে অবান্তররা সন্দেহে পড়বে।”

গায়েবের সময়ে এই ব্যক্তিরা সর্বাধিক চেষ্টা করে ইমামের প্রতি বিশ্বাস দুর্বল করতে, কিন্তু গায়েবের এই পরিস্থিতি নিজেদের বিভ্রান্তি ও ধ্বংসের ক্ষেত্রেও পরিণত হয়।

সময় নির্ধারণের নিষেধাজ্ঞা

অনেক হাদিসই স্পষ্টভাবে বলে, ইমামের আবির্ভাবের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা যাবে না। সময় নির্ধারণকারীরা মিথ্যা দাবি করে মানুষের মনে ভিত্তিহীন প্রত্যাশা, অস্থায়ী উত্তেজনা এবং পরবর্তী হতাশা সৃষ্টি করে। আবির্ভাব হঠাৎ এবং শুধুই আল্লাহর ইচ্ছায়, তাই সময় নির্ধারণ ভুল এবং বিপদজনক।

সমষ্টিগত অর্থ:

ইমাম হাসান আসকরের এই বক্তব্য শিয়াদের জন্য স্পষ্ট পথনির্দেশ:

  1. সঠিকভাবে ইমামকে চেনা – যা ধর্মীয় জীবন ও জাহেলিয়াতের পৃথকীকরণের মূল।
  2. মাসুমদের শিক্ষা ও অন্তর্দৃষ্টি (বাছিরাত) অনুসরণ করা – যা গায়েবের সময়ের ফিতনার মোকাবেলায় শক্তি দেয়।

এটি অজ্ঞতা ও মিথ্যাবাদীদের ফাঁদ থেকে রক্ষা করে এবং বিশ্বাস ও সক্রিয় প্রত্যাশার পথে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button