শিশুর দাঁত ওঠা নিয়ে অভিভাবকদের জন্য করণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন । প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শিশুর দাঁত ওঠা
শিশুর দাঁত ওঠা তার শারীরিক, স্নায়বিক ও মানসিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা সাধারণত ৪ থেকে ৭ মাসের মধ্যে শুরু হয়। এই সময়ে শিশুর দুধের দাঁত মাড়ির নিচ থেকে বের হতে শুরু করে এবং মুখের উপরিভাগে আসে। এই প্রক্রিয়ার সময় শিশুর জন্য ব্যথা, অস্থিরতা, জ্বর এবং আচরণের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে, যা অভিভাবকদের, বিশেষ করে মাতাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং এবং কখনো উদ্বেগজনক হতে পারে।
দুধের দাঁত
দাঁত শিশুদের খাদ্য গ্রহণ, ভাষা দক্ষতা, চোয়ালের বৃদ্ধি এবং এমনকি সুন্দর হাসির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শিশুর দাঁত ওঠার লক্ষণগুলো চেনা এবং এই সময়ে সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
এই নিবন্ধে ফিরোজ শিশুর দাঁত ওঠার প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছে। তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে থাকুন।
শিশুর দাঁত ওঠার লক্ষণসমূহ
শিশুর দাঁত ওঠা
শিশুর দাঁত ওঠার লক্ষণ প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে, তবে বেশিরভাগ শিশুর মধ্যে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। এই লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানা অভিভাবকদের জন্য এই ধাপটি মোকাবিলা করা সহজ করে তোলে:
১.শিশুর লালা বৃদ্ধি: অতিরিক্ত লালা শিশুর জামা ভিজিয়ে দিতে পারে বা মুখের চারপাশের ত্বককে উত্তেজিত করতে পারে।
২.অস্থিরতা ও ঘন ঘন কান্না: মাড়ির ব্যথার কারণে শিশু অস্বস্তি অনুভব করে এবং দীর্ঘ সময় কান্না করতে পারে।
৩.বস্তুর চিবানোর প্রবণতা: মাড়ির চাপ কমানোর জন্য শিশু বিভিন্ন জিনিস মুখে নিয়ে চিবাতে চায়।
৪.মাড়ির লালভাব ও ফোলা: দাঁতের উঠার জায়গা ফুলে যেতে পারে, সংবেদনশীল হতে পারে এবং কখনও ব্যথা হতে পারে।
৫.হালকা জ্বর: শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি স্বাভাবিক। তবে উচ্চ জ্বর অন্য কোনো রোগের সংকেত হতে পারে।
৬.ঘুমের ব্যাঘাত: মাড়ির ব্যথার কারণে রাতের ঘুম ভাঙতে পারে।
৭.খাদ্যগ্রহনে আগ্রহ কমা: মাড়ির ব্যথার কারণে শিশু দুধ বা খাবারে আগ্রহ দেখাতে পারে না।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ: যদি শিশুর জ্বর ৩৮.৫ ডিগ্রির বেশি হয়, ডায়রিয়া খুব তীব্র হয় বা শিশু অতি দুর্বল অনুভব করে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এই ধরনের লক্ষণ সাধারণত দাঁত ওঠার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এবং অন্য কোনো রোগের সংকেত হতে পারে।
শিশুর দাঁত ওঠার বয়স
শিশুর দাঁত ওঠা
শিশুর দাঁত ওঠার বয়স তার জিনেটিক, খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। কিছু শিশু ৪ মাসের মধ্যে প্রথম দাঁত পান, আবার কিছু শিশু ১২ মাস পর্যন্ত কোনো দাঁত পান না। নিচের সূচি প্রায়শই দুধের দাঁতের ওঠার সময় দেখায়:
দাঁতের ধরন | প্রায়শই ওঠার সময় |
নীচের সামনের দাঁত | ৬ থেকে ১০ মাস |
উপরের সামনের দাঁত | ৮ থেকে ১২ মাস |
পাশের দাঁত | ৯ থেকে ১৬ মাস |
প্রথম পেছনের দাঁত (মোলার) | ১৩ থেকে ১৯ মাস |
চিপ দাঁত (কানাইন) | ১৬ থেকে ২২ মাস |
দ্বিতীয় পেছনের দাঁত (মোলার) | ২৫ থেকে ৩৩ মাস |
৩ বছর বয়স পর্যন্ত অধিকাংশ শিশুর ২০টি দুধের দাঁত থাকে। যদি কোনো শিশু ১২ মাসের পরেও কোনো দাঁত না পান, তবে এই বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উত্তম।
শিশুর দাঁত ওঠার ঘরোয়া চিকিৎসা
শিশুর দাঁত ওঠা
শিশুর মাড়ির ব্যথা কমানোর এবং দাঁত ওঠার সঙ্গে যুক্ত লক্ষণগুলো নরম করার জন্য নিরাপদ এবং ঘরোয়া কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে:
১-ঠান্ডা দাঁতের খেলনা (Teething Ring): ঠান্ডা দাঁতের খেলনা ব্যবহার করুন (বরফযুক্ত নয়)। এটি সাময়িক অনুভূতিহীনতা তৈরি করে এবং মাড়ির প্রদাহ কমায়।
২-পরিষ্কার আঙ্গুল দিয়ে মাড়ি ম্যাসাজ: হাত ভালো করে ধুয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে শিশুর মাড়ি ম্যাসাজ করুন, এতে দাঁতের চাপ কমে।
৩-শিশুর দাঁতের জেল: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুদের জন্য তৈরি নাড়ী-নিরোধক জেল ব্যবহার করা যায়, যা সাধারণত প্রদাহ কমানোর উপাদান থাকে।
৪-ঠান্ডা ও নরম খাবার: ঠান্ডা আপেলের পিউরি, দই বা ফ্রিজের কচি কলা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। অবশ্য নিশ্চিত হতে হবে যে শিশু খাবার খাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
৫-ঠান্ডা ও পরিষ্কার কাপড়: একটি পরিষ্কার কাপড় ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে শিশুকে দিতে পারেন চিবানোর জন্য। এটি সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি।
শিশুর দাঁত ওঠার প্রভাবে আচরণের পরিবর্তন
শিশুর দাঁত ওঠা
শিশুর দাঁত ওঠার সময় তার আচরণে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। শিশু বেশি কান্নাকাটি করতে পারে, অভিভাবকের কোলে থাকতে চাইতে পারে বা ঘুমের ব্যাঘাত অনুভব করতে পারে। এই সময়ে অভিভাবকের ধৈর্য এবং শান্ত পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত কার্যকর।
কিছু শিশু এই সময়ে মায়ের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে যেতে পারে বা দুধ খাওয়া এড়াতে পারে। সৌম্য সঙ্গীত, শারীরিক স্পর্শ এবং শান্ত খেলাধুলা শিশুর উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে।
শিশুর দুধের দাঁতের যত্ন
শিশুর দাঁত ওঠা
প্রথম দাঁত উঠার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মুখের স্বাস্থ্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। তাই নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অবশ্যই মেনে চলা উচিত:
১.প্রতিটি দুধ খাওয়ার পর স্টেরাইল গজ বা নরম কাপড় দিয়ে দাঁতগুলো পরিষ্কার করুন।
২.২ বছরের নিচের শিশুর জন্য ফ্লোরাইড ছাড়া বিশেষ শিশুর দাঁতের মলম ব্যবহার করুন।
৩.শিশুকে মিষ্টি খাবার বা চিনি যুক্ত পানীয় দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৪.যদি দাঁতে সাদা দাগ, ক্ষয় বা মুখের দুর্গন্ধ দেখা দেয়, শিশুদের দন্তরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
কবে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
শিশুর দাঁত ওঠা
নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে চিকিৎসক বা শিশুর দাঁতের বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া জরুরি:
১.দাঁত ওঠার ক্ষেত্রে অত্যধিক বিলম্ব (১২ মাসের পরও দাঁত না ওঠা)
২.উচ্চ এবং স্থায়ী জ্বর
৩.অতিরিক্ত অবসন্নতা বা খাওয়ায় আগ্রহের অভাব
৪.মাড়ি থেকে রক্তপাত
৫.দাঁতের বিকৃতি, অস্বাভাবিক আকৃতি বা অসমভাবে বৃদ্ধি পাওয়া
সুতারাং: শিশুর দাঁত ওঠা হলো শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের একটি স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা মাড়ির ব্যথা, জ্বর, অস্থিরতা এবং আচরণের পরিবর্তনের মতো লক্ষণের সঙ্গে যুক্ত। এই লক্ষণগুলো চেনা, ঘরোয়া যত্ন প্রয়োগ এবং দুধের দাঁতের সঠিক যত্ন নেওয়া শিশুর এবং অভিভাবকের জন্য এই অভিজ্ঞতাকে অনেকটা সহজ ও শান্তিপূর্ণ করে তুলতে পারে।
অভিভাবকদের উচিত ধৈর্য, সচেতনতা এবং সঠিক যত্নের মাধ্যমে এই ধাপটি সফলভাবে পার করা। যদি কোনো উদ্বেগজনক লক্ষণ দেখা দেয়, তবে চিকিৎসক বা শিশুর দাঁতের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে শিশুর মুখ ও দাঁতের সুস্থতার জন্য দুধের দাঁতের সঠিক যত্ন শুরু থেকেই অত্যন্ত জরুরি।