বিশ্ববিশেষ সংবাদ

লেবাননের মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েলের নতুন খেলা: হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণের ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: কয়েক দিন আগেও যখন ইসরায়েল লেবাননে সামরিক আগ্রাসন জোরদার করছিল, ঠিক সেই সময়েই ওয়াশিংটন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়িয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। হিব্রু সূত্রগুলো জানাচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে, হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করা কোনো সহজ কাজ নয়। তাই আপাতত লেবাননকে নতুন করে সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ ঠেকাতে ওয়াশিংটন সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে।

যখন যুক্তরাষ্ট্র লেবাননকে সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনায় বসাতে, সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে চাপ অব্যাহত রেখেছে, ঠিক তখনই ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননের বিরুদ্ধে আগ্রাসন আরও বিস্তৃত করেছে। এই উত্তেজনাপূর্ণ প্রেক্ষাপটে সামনের সপ্তাহে একাধিক কূটনৈতিক তৎপরতা প্রত্যাশিত হলেও সবার দৃষ্টি মূলত ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের দিকেই নিবদ্ধ।

লেবানন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের নতুন কূটনৈতিক তৎপরতা

হিব্রু গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত টম ব্যারাক সোমবার তেলআবিবে একাধিক কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এসব উদ্যোগের মূল লক্ষ্য—লেবাননের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়া ঠেকানোর উপায় নিয়ে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার প্যারিসে লেবাননের সেনাবাহিনীকে সমর্থনের লক্ষ্যে একটি প্রাথমিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। একই দিনে মিসরের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা মাদবুলি কায়রোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন ও নতুন রাজনৈতিক ও সামরিক কাঠামোয় ‘মেকানিজম কমিটি’র (যা যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করে) বৈঠকে অংশ নিতে লেবানন সফর করবেন।

এই প্রসঙ্গে দৈনিক আল-আখবার অবগত সূত্রের বরাতে জানায়—মিসরের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর, যেখানে তিনি লেবাননের তিন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, মূলত উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে কায়রোর উদ্যোগের অংশ। তবে মিসর সচেতনভাবেই লেবাননিদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলো লক্ষ্য করছে—বিশেষত বৈরুতে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদুল আতি যে কঠোর বক্তব্য ও ইসরায়েলি হুমকির প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, তা নিয়ে।

লেবাননে ইরানবিরোধী উসকানির নেপথ্য কাহিনি

সূত্রগুলো আরও জানায়, একই সময়ে লেবাননের ভেতরে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার লক্ষ্যে একটি উসকানিমূলক পরিকল্পনা এগিয়ে চলছে—যা প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন ও প্রধানমন্ত্রী নওয়াফ সালামের নীরবতার মধ্যেই বাস্তবায়নের চেষ্টা হচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, ‘লেবানিজ ফোর্সেস’ দলের নেতা সামির জাজা—যিনি পুরোপুরি মার্কিন ও ইসরায়েলি নীতির অনুসারী—এই পরিকল্পনার মূল নায়ক। তাঁর দলের প্রতিনিধি ও লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউসুফ রাজ্জির মাধ্যমে এ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।

এই উসকানিমূলক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য—লেবাননে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা এবং ভবিষ্যতে কোনো ইরানি কর্মকর্তাকে বৈরুতে প্রবেশ করতে না দেওয়া। এই অবস্থান স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে লেবানিজ ফোর্সেস–ঘনিষ্ঠ সংসদ সদস্য গিয়াস ইয়াজবেকের বক্তব্যে; তিনি প্রকাশ্যে ইউসুফ রাজ্জিকে ইরানি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার এবং নতুন রাষ্ট্রদূত গ্রহণ না করার আহ্বান জানিয়েছেন।

আল-আখবার জানায়, এসব উসকানির জবাবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে— লেবাননে নতুন ইরানি রাষ্ট্রদূতের প্রবেশসংক্রান্ত প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে এবং আমরা আশা করি, বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই সম্পন্ন হবে। একই সঙ্গে তেহরান লেবাননের বন্ধুপ্রতিম শক্তিগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—দেশটির বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অংশের মধ্যে সংলাপ ও বোঝাপড়ায় মনোযোগ দেওয়ার জন্য।

লেবানন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েলের নতুন ‘ভূমিকা-বণ্টন’

ইসরায়েলের আগ্রাসন ও চাপের প্রেক্ষাপটে বাহ্যিকভাবে পরিস্থিতিতে তেমন পরিবর্তন না এলেও, ইসরায়েলি গণমাধ্যম ও নিরাপত্তা মহল নিয়মিতভাবে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে নতুন ও বড় ধরনের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতির খবর প্রকাশ করে চলেছে।

তবে নতুন দিক হলো—সাম্প্রতিক দিনে হিব্রু সূত্রগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে ইসরায়েলকে এমন কোনো সর্বাত্মক অভিযানে যেতে দিচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলি চ্যানেল ১২–এর সামরিক বিশ্লেষক শাই লেভি জানান, তেলআবিব যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে—যাতে লেবানন সরকারকে হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার ‘শেষ সুযোগ’ দেওয়া হয়। এই সুযোগের মেয়াদ চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ইসরায়েলকে উত্তর সীমান্তে পরবর্তী ধাপে যেতে বাধা দিচ্ছে এবং চাপ দিচ্ছে যেন তারা কেবল লক্ষ্যভিত্তিক হামলায় সীমাবদ্ধ থাকে। একই সঙ্গে লেবানন সরকারের জন্য নতুন বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে তারা হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণের পদক্ষেপ জোরদার করে।

লেভি আরও জানান, যদিও মার্কিন–ইসরায়েলি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে ইসরায়েল বড় অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং বিমান বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে, তবুও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন—এ পর্যন্ত চালানো হামলা হিজবুল্লাহকে কিছুটা দুর্বল করেছে, কিন্তু তাদের হুমকি পুরোপুরি দূর করতে পারেনি।

এই ইসরায়েলি সাংবাদিকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপই বর্তমানে লেবাননের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ ঠেকিয়ে রেখেছে। ওয়াশিংটন বড় ধরনের স্থল অভিযান বা ব্যাপক বিমান হামলার বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখনো এমন কোনো লক্ষণ নেই যে লেবানন সরকার হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণে সক্ষম বা আগ্রহী। বরং বৈরুতের কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন—হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ নিলে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে, যা লেবাননের মানুষ গভীরভাবে ভয় পায়।

হাআরেতজ: জোর করে নিরস্ত্রীকরণ অসম্ভব

হিব্রু দৈনিক হাআরেতজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে হিজবুল্লাহ এখনো ‘সংযম ও প্রতিক্রিয়াহীনতা’র কৌশলে অটল রয়েছে।

পত্রিকাটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত লেবাননকে হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণের জন্য আরও দুই মাস সময় দিতে সম্মত হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দূত টম ব্যারাক সম্প্রতি স্বীকার করেছেন—
“বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করা অসম্ভব। বরং আমাদের ভাবতে হবে, কীভাবে তাদের অস্ত্র ব্যবহারে বাধা দেওয়া যায়।”

একই প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত মিশেল ইসা হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে চাপ দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন— যদি নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব না হয়, তাহলে আমাদের তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।

উপসংহার:

লেবানন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক তৎপরতা স্পষ্ট করে দেয়—হিজবুল্লাহকে শক্তি প্রয়োগে ভেঙে ফেলা বাস্তবসম্মত নয়। তাই ওয়াশিংটন এখন যুদ্ধের আগুন নিয়ন্ত্রণে রেখে সময় কিনছে, আর ইসরায়েল বাধ্য হয়ে সেই কৌশলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। এই নতুন ভূমিকা-বণ্টন মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মানচিত্রে আরেকটি জটিল অধ্যায়ের সূচনা করছে।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button