ধর্ম ও বিশ্বাসইতিহাসবিশেষ সংবাদ
রেওয়ায়াতে হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.আ.)–এর মাকাম ও মর্যাদা
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৪ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মদ হাদি হেদায়েত বলেন, ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, তাঁর সন্তানদের একজন কন্যা, যার নাম হবে ‘ফাতিমা’, কোম শহরে সমাহিত হবেন। এ রেওয়ায়াতগুলো প্রমাণ করে যে হযরত মাসুমা (সা.আ.) ছিলেন এক প্রতিশ্রুত ব্যক্তিত্ব, যাঁর সমাধিস্থল হিসেবে আহলে বাইত (আ.) কোম শহরের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
কোম; আহলে বাইতের (আ.) হারাম (حرم)
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মদ হাদি হেদায়েত হাওজা নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, আল্লাহ তা’আলা সূরা আনকাবুতের আয়াত ৬৭–এ ইরশাদ করেন: «أَوَلَمْ یَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا حَرَماً آمِناً» তারা কি দেখেনি যে আমি একটি অঞ্চলকে নিরাপদ হারাম বানিয়েছি? মক্কা মুকাররমা আল্লাহর হারাম, তবে রেওয়ায়াত অনুযায়ী আরও কিছু শহর এই হারামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আল্লামা মাজলিসির বিহারুল আনওয়ার–এ “যেসব শহর আল্লাহর প্রশংসায় বিশেষভাবে উল্লেখিত” শিরোনামে একটি অধ্যায় আছে, যেখানে প্রথম শহর হিসেবে কোমকে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কোম হচ্ছে আহলে বাইতের সন্তানদের আশ্রয়স্থল ও তাশায়্যুর কেন্দ্র। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন,
اِنَّ لِلّهِ حَرَما وَ هُوَ مَکَّةُ، وَ لِرَسُولِهِ حَرَما وَ هُوَ الْمَدینَةُ، وَ لاَِمیرِ الْمُؤمِنینَ حَرَما وَ هُوَ الکُوفَةُ، وَ لَنا حَرَما وَ هُوَ قُم، وَ سَتُدْفَنُ فیها امْرَأةٌ مِنْ وُلْدی تُسَّمی فاطِمةُ، مَنْ زارَها وَ جَبَتْ لَهُ الجَنَّةُ.
“আল্লাহর হারাম হলো মক্কা, রাসূলুল্লাহর (সা.) হারাম হলো মদিনা, আমিরুল মু’মিনিনের হারাম হলো কুফা এবং আমাদের হারাম হলো কোম। আর শিগগিরই সেখানে আমার সন্তানদের একজন কন্যা, যার নাম হবে ফাতিমা, সমাহিত হবেন। যে তাঁকে জিয়ারত করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে।”
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন হেদায়েত বলেন, ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ভবিষ্যদ্বানীকরেছিলেন যে ভবিষ্যতে ফাতিমা নামে তাঁর এক কন্যাসন্তান, কোমে সমাহিত হবেন। আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলির ভাষায়, এ রেওয়ায়াত প্রমাণ করে হযরত মাসুমা (সা.আ.) ছিলেন প্রতিশ্রুত এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর উপস্থিতি কোম শহরের নিরাপত্তা ও পবিত্রতার কারণ হয়েছে।
হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর বিশেষ মর্যাদা
এই হাওজায়ে ইলমিয়ার শিক্ষক উল্লেখ করেন, আমাদের দেশে প্রায় ৬১৫০ জন ইমামজাদা আছেন, শুধু কোম শহরেই ৪০০ জন ইমাম মূসা কাযিম (আ.)–এর সন্তান সমাহিত। কিন্তু সব ইমামজাদাদের মধ্যে মাত্র তিনজনের জন্য মাসূর জিয়ারতনামা রয়েছে—হযরত আবুল ফজল আল-আব্বাস (আ.), হযরত আলী আকবর (আ.) এবং হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)। তিনি আরও বলেন, ইমাম রেজা (আ.) একবার সা’দ আশআরিকে এক চিঠির উত্তরে বলেছিলেন, «لَنا عِندَکُم قَبر»—“তোমাদের মাঝে আমাদের একটি কবর আছে।” অর্থাৎ, আমাদের এক টুকরো সত্তা সেখানে সমাহিত। এ কবরই হলো হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর মাজার শরীফ, যা আহলে বাইতের (আ.) হারাম হিসেবে গণ্য হয়।
কোমকে ইলম ও তাশায়্যুর কেন্দ্র বানানো—মাসুমা (সা.)–এর আসল কারামাত
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন হেদায়েত, আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলির বয়ান উল্লেখ করে বলেন, হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর কারামাত শুধু রোগীদের শেফা দেওয়া বা হাওয়াইজ পূরণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর আসল কারামাত হলো, এক বিরানভূমি কোমকে ইলম ও তাশায়্যুর বৈশ্বিক কেন্দ্র বানানো।
তিনি যোগ করেন, কোমে যে দারস, তাফসির ও ইসলামি উলুমের ধারাপ্রবাহ গড়ে উঠেছে, সবই হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর বরকতের ফল। যেমন আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলির তাফসিরে তাসনিম, যা হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর হারামের পাশের এই ইলমি পরিবেশের বরকতেই প্রস্ফুটিত হয়েছে।
হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.আ.)—ইমামে যামানার সাহায্যের আদর্শ
এই ধর্মীয় বিশ্লেষক জোর দিয়ে বলেন, হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর মহানতার কেন্দ্রবিন্দু একটি শব্দ—“ইমাম হাজেরের নুসরাত”। তিনি ইমাম রেজা (আ.)–এর সহায়তায় ভালোবাসা থেকে মদিনা থেকে তুসের পথে যাত্রা করেন এবং সেই পথে শহীদ হন। কোমে মাত্র ১৭ দিন অবস্থানকালে হযরত মাসুমা (সা.আ.) আহলে বাইতের (আ.) মাআরিফ শিক্ষা দেন, তা প্রচার করেন এবং শিয়াদের গড়ে তোলেন।

হযরত মাসুমা (সা.আ)–এর অদ্বিতীয় সম্মান
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন হেদায়েত বলেন, কোমবাসী সবসময় এই বানু’র উপস্থিতিকে তাদের জন্য গৌরব মনে করেছে। তাঁর প্রতি যে বিশেষ সম্মান দেখানো হয়েছে, তা এসেছে তাঁর অনন্য মর্যাদা থেকে—তিনি ছিলেন এক ইমামের কন্যা, আরেক ইমামের বোন, এবং আরেক ইমামের ফুফু। তিনি ঐতিহাসিক তুলনা টেনে বলেন, হযরত জয়নাব কুবরা (সা.আ.)–ও একই মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে শামে তাঁকে ভয়াবহ বিপদ–আপদ ও দুঃখ–কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, যা আহলে বাইতের (আ.) হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর হারাম—আলেম ও মুজাহিদ তৈরির মাদ্রাসা
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন হেদায়াত শেষে বলেন, হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর হারাম শুধু একটি পবিত্র স্থান নয়, বরং ইসলামি আলেম ও মুজাহিদদের গড়ে তোলার এক মহান মাদ্রাসা। ইতিহাস জুড়ে যত বড় বড় হাওজার আলেম সৃষ্টি হয়েছে, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে হযরত মাসুমা (সা.আ.)–এর তাআলিম ও তাযকিয়ার ছাত্র। এই বরকত আজও অব্যাহত রয়েছে।



