রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দৃষ্টিতে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর সীরাত ও চরিত্রের অপূর্ব মহিমা
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গভীর ভালোবাসা কেবল পিতা ও কন্যার স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কুরআনের আয়াত, সহিহ হাদিস এবং ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়—এই ভালোবাসার ভিত্তি ছিল আধ্যাত্মিক মর্যাদা, নৈতিক পূর্ণতা ও আল্লাহপ্রদত্ত এক অনন্য অবস্থান। নবী করিম (সা.)-এর আচরণ ও বক্তব্যে ফাতিমা (সা.আ.) ছিলেন শুধু কন্যা নন, বরং সত্য ও ন্যায়ের প্রতিচ্ছবি।
ফাতিমা (সা.)-এর মর্যাদা: কুরআনের দৃষ্টিতে
কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا
(সূরা নূর, আয়াত ৬৩) তোমরা রাসুলকে একে অপরকে ডাকার মতো ডেকো না।”
এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আর সাধারণ নামে ডাকতেন না; বরং বলতেন—“ইয়া রাসুলাল্লাহ” বা “ইয়া আইয়্যুহান নাবী।
হযরত ফাতিমা (সা.) নিজেই বর্ণনা করেন—এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর তিনি আর পিতাকে “আব্বাজান” বলে ডাকতে সাহস করতেন না। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে “ইয়া রাসুলাল্লাহ” বলে সম্বোধন করতেন। তখন নবী করিম (সা.) তাঁকে বলেছিলেন—
يَا فَاطِمَةُ إِنَّهَا لَمْ تَنْزِلْ فِيكِ وَلَا فِي أَهْلِكِ وَلَا نَسْلِكِ، أَنْتِ مِنِّي وَأَنَا مِنْكِ، إِنَّمَا نَزَلَتْ فِي أَهْلِ الْجَفَاءِ وَالْغِلْظَةِ مِنْ قُرَيْشٍ. قُولِي: يَا أَبَتِ فَإِنَّهَا أَحْيَا لِلْقَلْبِ وَأَرْضَى لِلرَّبِّ
“হে ফাতিমা! এই আয়াত তোমার জন্য নাজিল হয়নি, না তোমার পরিবার ও বংশের জন্য। তুমি আমার অংশ, আর আমি তোমার অংশ। এটি নাজিল হয়েছে কুরাইশের রূঢ় ও নির্দয় লোকদের সম্পর্কে। তুমি আমাকে বলো—‘আব্বাজান’; এতে আমার হৃদয় সজীব হয় এবং আমার রব সন্তুষ্ট হন।(হাদিস: শিয়া ও সুন্নি সূত্রে বর্ণিত)
এই বর্ণনা স্পষ্ট করে—ফাতিমা (সা.)-এর সঙ্গে নবীর সম্পর্ক ছিল ব্যতিক্রমী ও আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত।
হাদিসে নবীর ভালোবাসার ঘোষণা
১. সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের পরিচয় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
مَا كَانَ أَحَدٌ مِنَ الرِّجَالِ أَحَبُّ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ مِنْ عَلِيٍّ وَلَا مِنَ النِّسَاءِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ فَاطِمَةَ
পুরুষদের মধ্যে আলি (আ.)-এর চেয়ে আমার কাছে প্রিয় কেউ নেই, আর নারীদের মধ্যে ফাতিমা (সা.)-এর চেয়ে প্রিয় কেউ নেই।(হাদিস: আয়েশা থেকে বর্ণিত; শিয়া ও সুন্নি গ্রন্থে উল্লেখিত)
২. সফর ও বিদায়ের সময় ফাতিমা (সা.আ.) হাদিসে এসেছে—
كَانَ أَخِرُ مَنْ يُوَدِّعُهُ رَسُولُ اللَّهِ فِي السَّفَرِ فَاطِمَةُ وَأَوَّلُ مَنْ يَلْتَقِي بِهِ عِنْدَ الرُّجُوعِ فَاطِمَةُ
রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন সফরে যেতেন, তখন সবার শেষে ফাতিমার (সা.) সঙ্গে বিদায় নিতেন; আর সফর থেকে ফিরে এসে সবার আগে তাঁর কাছেই যেতেন।”
(হাদিস: বহু সূত্রে বর্ণিত)
৩. ফাতিমাকে কষ্ট দেওয়া মানেই নবীকে কষ্ট দেওয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন—
مَنْ آذَاهَا فَقَدْ آذَانِي، وَمَنْ أَغْضَبَهَا فَقَدْ أَغْضَبَنِي، وَمَنْ سَرَّهَا فَقَدْ سَرَّنِي، وَمَنْ سَاءَهَا فَقَدْ سَاءَنِي
“যে ফাতিমাকে কষ্ট দেয়, সে আমাকে কষ্ট দেয়; যে তাকে রাগান্বিত করে, সে আমাকে রাগান্বিত করে। যে তাকে আনন্দ দেয়, সে আমাকে আনন্দ দেয়; আর যে তাকে দুঃখ দেয়, সে আমাকে দুঃখ দেয়। (হাদিস: শিয়া ও সুন্নি উভয় সূত্রে সহিহভাবে বর্ণিত)
এই হাদিসগুলো এমন এক সময়ে বলা হয়েছিল, যখন নবীর জীবদ্দশায় কেউ ফাতিমা (সা.আ.)-কে কষ্ট দেওয়ার সাহস পেত না। এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কীকরণ ছিল, যা পরে ফাতিমা (সা.আ.)-এর উপর জুলুমের পূর্বাভাস দেয়।
উপসংহার
হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর প্রতি নবী করিম (সা.)-এর ভালোবাসা ছিল কেবল পিতৃত্বের সীমানা অতিক্রম করে আধ্যাত্মিক মর্যাদা ও নৈতিক উদাহরণের প্রতিফলন। তিনি কেবল একজন কন্যা নন—তিনি ছিলেন নবুওতের ধারক, ইমামতের রক্ষক এবং উম্মতের জন্য ন্যায়ের মাপকাঠি।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি—তিনি যেন আমাদের এই মহীয়সী নারীর প্রকৃত মর্যাদা বোঝার তাওফিক দেন এবং যারা রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর কন্যার হৃদয়ে আঘাত করার ষড়যন্ত্র করে, তাদের ক্ষতি তাদের দিকেই ফিরিয়ে দেন।
পাদটীকা
১. এই হাদিসের মর্ম বহু সূত্রে সুন্নি ঐতিহ্যেও বর্ণিত হয়েছে। ‘ইহকাকুল হক’, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ১৬৭।
২. সুরা নূর, আয়াত ৬৩।
৩. মনাকিব ইবন শহর আশুব’, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩২০।
৪. ফাযাইলুল খামসা’, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৩২।



