যে ঢেউ থামেনি: ইসরায়েলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে ব্রিটেনে টানা দুই বছরের প্রতিবাদ
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৭ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: গাজা যুদ্ধ শুরুর দুই বছর পরও থামেনি ব্রিটেনে ফিলিস্তিন সংহতির ঢেউ। সরকারি বিধিনিষেধ, রাজনৈতিক চাপ ও গণমাধ্যমের পক্ষপাতমূলক প্রচারণা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের পক্ষে জনআন্দোলন এখন ব্রিটিশ সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিরোধী শ্লোগানে উত্তাল ব্রিটেন
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের “তুফানুল আকসা” অভিযানের কয়েক দিনের মধ্যেই লন্ডনের রাস্তায় ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে হাজারো মানুষ নেমে আসে। রাজধানীর ট্রাফালগার স্কোয়ার, সংসদ ভবনের সামনের রাস্তা, এমনকি ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম ও গ্লাসগোর কেন্দ্রস্থল—সবখানেই মুখর হয়ে ওঠে স্লোগানে: “অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চাই”, “গাজার অবরোধের অবসান”, “ফিলিস্তিনের জন্য ন্যায়বিচার”।
লন্ডনের বৃহত্তম এক বিক্ষোভে প্রায় তিন লাখ মানুষ অংশ নেয় বলে আয়োজকেরা দাবি করেন। সেসব দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত এসব বিক্ষোভ নিয়মিতভাবে অব্যাহত থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা এক সাপ্তাহিক সামাজিক আন্দোলনে রূপ নেয়, যেখানে ফিলিস্তিনের পক্ষে জনমতের চাপ ক্রমেই তীব্র হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাস্তায়: নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব
শুধু রাস্তায় নয়, ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও হয়ে ওঠে এই আন্দোলনের নতুন ঘাঁটি। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে তাঁবু স্থাপন করে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে। তাদের দাবি—বিশ্ববিদ্যালয় যেন ইসরায়েলি অস্ত্রনির্মাতা ও তাদের সহযোগী কোম্পানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করে।
২০২৩ সালের শীত থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের বসন্তে এ আন্দোলন পূর্ণাঙ্গ ছাত্র-আন্দোলনে রূপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের অনুপ্রেরণায় ব্রিটেনের ক্যাম্পাসগুলোতেও রাতভর প্রতিধ্বনিত হয় আরবি সঙ্গীত, স্বাধীনতার কবিতা ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের বক্তৃতা।
সরকারি দমননীতি ও গ্রেপ্তারের বন্যা
সরকার ও পুলিশের প্রতিক্রিয়া ছিল কঠোর। ২০২৪ সালের মে মাসে লন্ডনে এক বিশাল সমাবেশ থেকে ১৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয় সরকার।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে Palestine Action নামের একটি সংস্থাকে “Terrorism Act 2000” আইনের আওতায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর পর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সেই নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রতি সমর্থন দেখানোর অভিযোগে শত শত বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়।
- ৯ আগস্ট লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে প্রায় ৪৬৬ জনকে,
- আর ৬ সেপ্টেম্বর প্রায় ৮৯০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানায়, এদের অধিকাংশই কেবল পতাকা বা ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, “এই ধরনের আইন প্রয়োগ গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য গভীর উদ্বেগজনক।”
বয়কট ও সামাজিক প্রচারণার উত্থান
রাস্তায় প্রতিবাদের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধও বেড়েছে। ইসরায়েলের সহযোগী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা (BDS) আন্দোলন নতুন গতি পায়।
হাজারো নাগরিক ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান। কয়েকটি বড় খুচরা বিক্রেতা জানায়, ইসরায়েলি পণ্যের বিক্রি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #FreePalestine ও #CeasefireNow হ্যাশট্যাগে ভেসে আসে গাজার মানবিক বিপর্যয়ের অসংখ্য ভিডিও ও গল্প। একই সঙ্গে ব্রিটেন থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির অনুমতি বাতিলের দাবিও জোরালো হয়।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও দলের ভেতর বিভাজন
২০২৪ সালে ক্ষমতায় আসা লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার ইসরায়েল-সংক্রান্ত নীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আনেননি। সরকারের অবস্থান “ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার” বজায় রাখার পক্ষে থাকায় দলটির মধ্যেই ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
সংসদ সদস্য যাহরা সুলতানা ও রিচার্ড বারগেন সরকারের অবস্থানকে “অমানবিক” ও “যুদ্ধের সহযোগিতা” বলে আখ্যা দেন। তবে সরকার জাতিসংঘে ইসরায়েলবিরোধী কোনো বাধ্যতামূলক প্রস্তাবে সমর্থন দেয়নি।
শিক্ষাঙ্গন ও সংস্কৃতিজগতে সংহতি
শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খোলা চিঠিতে ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বলেন—“এটি মানবিক ও একাডেমিক স্বাধীনতার প্রশ্ন, কোনো রাজনৈতিক আনুগত্য নয়।”
ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টস এক বিবৃতিতে জানায়, “ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতির আন্দোলন মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে; এটি দমন করলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে।”
সংগীতশিল্পী রজার ওয়াটার্সসহ বহু শিল্পী লন্ডন ও ম্যানচেস্টারের মঞ্চে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছেন। লন্ডনের বিভিন্ন থিয়েটার, আর্ট গ্যালারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী ও নাটকে ফিলিস্তিনি মুক্তির আহ্বান উচ্চারিত হয়েছে।
সরকারের কঠোর অবস্থান
২০২৫ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী স্টারমার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিক্ষোভকে “ব্রিটিশ মূল্যবোধের পরিপন্থী” বলে মন্তব্য করেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি গত দুই বছরের দমননীতিরই ধারাবাহিকতা।
অন্যদিকে সরকার নতুন আইন আনতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে পুলিশ “পুনরাবৃত্ত প্রতিবাদ” ঠেকাতে একই স্থানে ধারাবাহিক সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এটি প্রতিবাদের মৌলিক অধিকার সংকুচিত করার আশঙ্কা তৈরি করছে।
অটল জনমত
সব বাধা সত্ত্বেও আন্দোলন থামেনি। বরং এটি আরও বিস্তৃত হয়েছে। রাজধানী লন্ডন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, দোকানের শোকেস থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবখানেই উচ্চারিত হচ্ছে এক সুর: “ফিলিস্তিনের ন্যায়ের পক্ষে আমাদের কণ্ঠ থামবে না।”
ব্রিটিশ জনগণ আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রশ্ন তুলছে—ইসরায়েলের প্রতি অন্ধ সমর্থনের রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্য কতটা?
আর আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিচ্ছেন: “ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তাঘাট ছাড়ব না।”



