যুদ্ধের ময়দানে কোরআনের তাফসীর
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আটবছরের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিরক্ষা যুদ্ধ (দেফা-ই মোগদাস) ছিল এক গভীর ও বিস্তৃত আধ্যাত্মিক যাত্রা, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোরআন শরিফ। কোরআন, পথপ্রদর্শক গ্রন্থ হিসেবে, জিহাদী নীতি ও আইনকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে, ইরানের যোদ্ধারা এই শিক্ষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রকে এমন এক মঞ্চে পরিণত করেছিলেন, যেখানে আল্লাহর আয়াত ও নীতির বাস্তবায়ন ঘটেছে। কোরআন ও প্রতিরক্ষা যুদ্ধের এই সংযোগ কেবল মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি যুদ্ধকালে কোরআনের অর্থের জীবন্ত ও প্রয়োগমুখী তাফসীর হিসেবেও প্রকাশ পেয়েছে।
কোরআনের আধ্যাত্মিক নির্দেশনা ও আহলে বাইটের শিক্ষার সঙ্গে অনুপ্রাণিত হয়ে, ইরানের যোদ্ধারা প্রতিরক্ষা যুদ্ধে প্রার্থনা ও সংকেতকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এই কোরআনিক সংকেত ও আধ্যাত্মিক প্রার্থনা শুধু অভিযান শুরু করার সংকেত ছিল না, বরং এটি যোদ্ধাদের হৃদয়ে শান্তি, সাহস ও দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতো, যা তাদেরকে কঠিন যুদ্ধক্ষেত্রে স্থিতিশীল ও অদম্য রাখত।
স্থিতিশীলতা থেকে উদ্ভাবনী উদ্যোগ
সুরা আনফাল ১৬:
وَلَا تَوَلَّوْا مُدْبِرِينَ
যা শত্রুর মুখ ফিরে যাওয়া নিষিদ্ধ করে। এই আয়াত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জোটবদ্ধতা ও স্থিতিশীলতার গুরুত্বের প্রতিফলন।
সুরা মুহাম্মাদ (সা) ৪:
فَشُدُّوا الْوَثَاقَ
যুদ্ধক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ এবং শত্রুকে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয়তার প্রতীক। ইরানের প্রতিরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক অভিযানে এই নীতি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
সুরা আনফাল ৬০:
وَأَعِدُّوا لَهُم مَا اسْتَطَعْتُم مِن قُوَّةٍ
এটি নির্দেশ দেয় যে, পুরোপুরি প্রস্তুত থাকা এবং সশস্ত্রভাবে প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। প্রতিরক্ষা যুদ্ধ এই আয়াতকে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা নীতির মূল ভিত্তি ও মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা মন্তব্য করেন, এই প্রতিরক্ষা যুদ্ধ শুধু একটি স্থল-যুদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল কোরআনের শিক্ষার বাস্তবীকরণের মঞ্চ। এখানে ধৈর্য, স্থিতিশীলতা, আত্মত্যাগ ও আধ্যাত্মিকতার মূল্যবোধ প্রচারিত হয়েছিল। এই শিক্ষাগুলো ইরানকে শত্রুর আটবছরের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় থাকতে সাহায্য করেছে এবং সর্বশেষে জয় নিশ্চিত করেছে।
জিহাদ ও শহীদের আয়াত থেকে জীবন্ত প্রেরণা
কোরআন শরিফ, যার প্রতিটি আয়াত মানব জীবনকে আলোকিত করে, জিহাদ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ, ধর্ম ও পবিত্র ভূমির সুরক্ষা এবং ফিসাবিল্লাহ শহীদ হওয়ার মহিমা-র ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, এই শিক্ষাই মর্যাদাপূর্ণ প্রতিরক্ষা যুদ্ধের মূল ভিত্তি স্থাপন করেছে।
যেসব আয়াত, যেমন:
«وَقَاتِلُوا فِی سَبِیلِ اللَّهِ الَّذِینَ یُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا یُحِبُّ الْمُعْتَدِینَ» (বাকারা, ১৯০),

এবং
«وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِینَ» (আল-ইমরান, ১৩৯),
যোদ্ধাদের পথ প্রদর্শক বাতি হিসেবে জ্বলে উঠেছিল—যেখানে প্রতিটি অন্ধকার মুহূর্তে, প্রতিটি কঠিন পরীক্ষায় এই আয়াত তাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
শহীদ ও যোদ্ধারা এই আয়াতগুলোর প্রতি অটল বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেদেরকে জীবন পর্যন্ত লড়াই চালানোর দায়িত্ববোধে বাধ্য মনে করতেন। এই দৃঢ় ঈমানই যুদ্ধক্ষেত্রে তাদেরকে সাহসী, অদম্য এবং নৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে। আর এইই বিশ্বাস, এইই ত্যাগ ও সংকল্পের কারণে, তারা যুদ্ধে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।
কোরআনের এই বাণী ও আধ্যাত্মিক শক্তি প্রতিটি যোদ্ধার হৃদয়ে যেমন আশার দীপ জ্বালিয়েছে, তেমনি প্রতিটি প্রয়াসকে পরিপূর্ণতার সঙ্গে আলোকিত করেছে—যেন প্রতিটি জীবন, প্রতিটি আত্মত্যাগ কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বরং ইতিহাসেও সতর্ক এবং প্রেরণামূলক স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোরআনের আলোয় গড়ে ওঠা প্রতিরক্ষা সংস্কৃতি
মর্যাদাপূর্ণ প্রতিরক্ষা যুদ্ধ কেবল ভূ-রাজনৈতিক লড়াই ছিল না; এটি ছিল কোরআন শরিফের আধ্যাত্মিক ও বাস্তব ব্যাখ্যার একটি জীবন্ত মঞ্চ। যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধারা আল্লাহর নির্দেশ মেনে, এক গভীর বিপ্লবী ও জিহাদী মনোভাব পোষণ করেছিলেন। জিহাদ সংক্রান্ত আয়াতগুলি সরাসরি যুদ্ধের অর্থ বহন করলেও, এগুলো স্থিতিশীলতা, আল্লাহর সহায়তার প্রতি আস্থা এবং ঐক্যের রক্ষা-র মতো গভীর শিক্ষা বহন করতো।
সুরাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে সুরা ফাতহ, নসর, আনফাল ও ফজর আয়াতগুলি প্রতীকী ও বাস্তব প্রয়োগে ব্যবহৃত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন অভিযানকে কোরআনের সূরার নামের সঙ্গে যুক্ত করা হতো—যেমন “ওয়ালফজর” (সুরা ফজর থেকে) বা “নসর” (সুরা নসর থেকে)। এই নামকরণ কেবল প্রতীকী নয়, বরং আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের বাস্তব প্রতিফলন হিসেবে পরিচিত ছিল।
কোরআনিক সংকেত ও আধ্যাত্মিক প্রার্থনা
যোদ্ধারা প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময় কোরআনের শিক্ষা এবং আহলে বাইত (আ.)-এর আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, আল্লাহর নামে এবং ধর্মীয় ওয়ালীদের নাম জপ করে নিজেরা যুদ্ধকৌশল নির্ধারণ করতেন। যেমন:
«یا الله»، «یا علی بن ابیطالب», «الله اکبر»—এই শব্দগুলো কেবল অভিযান শুরু করার কৌশলগত সংকেত নয়, বরং গভীর আধ্যাত্মিক ও ঈমানি শক্তির প্রকাশ।
এই ধরনের শ্লোগান, যা কোরআনের আয়াত ও নবীজীর সুন্নাত থেকে উদ্ভূত, একদিকে যোদ্ধাদের উৎসাহ ও প্রেরণা যোগ করতো, অন্যদিকে তাদের হৃদয়ে শান্তি ও আত্মবিশ্বাস স্থাপন করতো। কোরআন শরিফ স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিচ্ছে:
«أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ» (সূরা রা’দ/২৮)
অর্থাৎ, আল্লাহর স্মরণে হৃদয় শান্ত হয়। প্রতিটি অভিযানের শুরুতে যোদ্ধারা আল্লাহ ও আহলে বাইতের নাম উচ্চারণ করলে, এই আয়াতের অর্থ সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিফলিত হত—হৃদয়ে স্থিরতা ও সাহসের জন্ম হতো।
এছাড়া, এই সংকেত ব্যবহারের মাধ্যমে যোদ্ধারা কোরআন ও আহলে বাইতের সুন্নাতের সঙ্গে অন্তরের গভীর সংযোগ স্থাপন করতেন। বিশ্বাসের দৃষ্টিতে, কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহ ও তার ওয়ালীদের নাম স্মরণ করা মানে হচ্ছে আল্লাহর অসীম শক্তির কাছে আশ্রয় নেওয়া। ফলে, যুদ্ধের সংকেতগুলো শুধুমাত্র শব্দ নয়, বরং দৃঢ় ঈমান, জিহাদী মনোভাব এবং আল্লাহর সহায়তার প্রতি আস্থার প্রকাশ হিসেবে গৃহীত হত।
আধ্যাত্মিক শক্তি ও আত্মত্যাগের ভিত্তি
যোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে কোরআনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে কোরআনের তিলাওয়াত তাদের মনোবল, হৃদয়ের শান্তি ও দলগত ঐক্য জোরদার করতো। এটি তাদেরকে মানসিক ও শারীরিক চাপের বিরুদ্ধে দৃঢ় রাখতে সাহায্য করতো। প্রকৃতপক্ষে, কোরআনের সঙ্গে সংযোগ ছিল তাদের আধ্যাত্মিক ও বাস্তব বিজয়ের মূল রহস্য।
কোরআনিক শিক্ষকদের মতে:
প্রতিরক্ষা যুদ্ধ কোরআনের জিহাদ সম্পর্কিত আয়াতের বাস্তব এবং সরাসরি ব্যাখ্যা, যা ঈমান, আত্মত্যাগ এবং মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে।
অর্থাৎ, কোরআনের নীতিমালা কেবল তাত্ত্বিক নয়, বরং বাস্তব জীবনের জিহাদ ও প্রতিরক্ষা কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়েছে।
কোরআনিক বিজয় ও সহায়তার ব্যাখ্যা
কোরআন শরিফ প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময় “আল্লাহর সহায়তা”-কে যোদ্ধাদের জন্য আধ্যাত্মিক ও আশাপ্রদ শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। এই শিক্ষার আলোকে, বিজয়কে চূড়ান্তভাবে দৃঢ় বিশ্বাস, আস্থা ও আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কার্যকরী উদ্যোগের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
যুদ্ধ ও তার ফলাফল কেবল ইতিহাস নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছার প্রাকাশ হিসেবে ধরা হতো, যেখানে মানুষের বিশ্বাস, ধৈর্য ও আত্মত্যাগই বিজয়ের মূল ভিত্তি। যেমন আয়াতে বলা হয়েছে:
«يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ»
অর্থাৎ, আল্লাহর সাহায্য ঈমানের পথ ও ধর্মীয় দায় পালনের সঙ্গে সাপেক্ষ। যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, তাদের পদচারণা স্থির হয় এবং চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত।



