কুরআনজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

যদি সৃষ্টিকর্তা ন্যায়পরায়ণ হন, তবে তিনি কেন তাঁর কিছু সৃষ্টিকে জন্ম থেকেই অসম্পূর্ণ রূপে গড়ে তুলেছেন?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৪ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: মৌলিক ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হলো—মানুষের সৃষ্টিকর্তার ওপর কোনো অধিকার নেই, তাই দুনিয়াবি নিয়ামতের পার্থক্যকে ন্যায়–অন্যায়ের মাপকাঠিতে দেখা যায় না; বরং তা আল্লাহর প্রজ্ঞার অংশ। সৃষ্টি–ব্যবস্থার কারণ–কার্য সম্পর্ক অনেক সময় শারীরিক অক্ষমতার কারণ হয়, আর এসব বৈষম্যকে পরকালে ন্যায়সঙ্গতভাবে পূরণ করা হয়।
ধর্মদর্শনের আলোচনায় বলা হয়—সৃষ্টির আল্লাহর প্রতি কোনো দাবী বা অধিকার নেই; অতএব দান-নিয়ামতের ভিন্নতা ন্যায়ের সঙ্গে নয়, প্রজ্ঞার সঙ্গে যুক্ত। সৃষ্টিজগতের কারণ–কার্যবিধি কখনো বিকলাঙ্গতার রূপে প্রকাশ পায় এবং পরমেশ্বর পরকালীন বিচার–বিভাজনে এই ব্যবধানসমূহ পূর্ণ ন্যায়ে প্রতিপূরণ করেন।

মার্কাজে মিল্লি-য়ে পাসোখগুইয়ে সোআলাতে দিনি সম্প্রতি এই প্রশ্নের উত্তরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে যে, “কেন আল্লাহ কিছু মানুষকে শারীরিক ত্রুটি বা রোগ নিয়ে জন্ম দেন? তাদের বক্তব্যের সারমর্ম নিম্নরূপ।

প্রথমেই বুঝতে হবে—ইসলামে বিচার বা “আদল”-এর প্রচলিত অর্থ হলো যার যে অধিকার, তা তাকে প্রদান করা। অর্থাৎ যেখানে কোনো অধিকারই নেই, সেখানে ন্যায় কিংবা অন্যায়—কোনোটাই প্রযোজ্য নয়। যেমন, আপনি যদি দুইজন দরিদ্রকে সহায়তা করেন—একজনকে ২০০০ টাকা, আরেকজনকে ১০০০—তাহলে দ্বিতীয় ব্যক্তি অভিযোগ করতে পারে না যে আপনি তাকে কম দিয়েছেন, কারণ আপনার প্রতি তার কোনো অধিকার ছিল না। আপনি নিজের ইচ্ছায় যা দিয়েছেন, তা ন্যায়–অন্যায়ের প্রশ্ন তৈরি করে না।

মানুষের অবস্থানও আল্লাহর প্রতি এমনই—আমাদের আল্লাহর উপর কোনো অধিকার নেই যে আমরা নেয়ামতের তারতম্য নিয়ে আপত্তি তুলব বা তাঁর ন্যায়বিচারকে প্রশ্ন করব। তবে নেয়ামতের বণ্টন ন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত না হলেও, তা আল্লাহর প্রজ্ঞার সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত। যেমন মানুষের দান-সহায়তাও তখনই প্রজ্ঞাসম্পন্ন হয়, যখন তার যৌক্তিক ভিত্তি থাকে।

দুনিয়ায় নেয়ামতের বৈচিত্র্য—স্বাস্থ্য, রোগ, শারীরিক অক্ষমতা—তখনই যুক্তিসঙ্গত যখন এর পেছনে উপযুক্ত কারণ থাকে। বাস্তবে মানুষের অনেক শারীরিক ত্রুটি পৃথিবীর প্রাকৃতিক কারণ–কার্য সম্পর্কের ফল। উদাহরণস্বরূপ, কোনো মা যদি অজ্ঞতা বা অবহেলায় গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকর ওষুধ সেবন করেন, তা গর্ভস্থ শিশুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এখানে আল্লাহ সরাসরি শিশুর ঘাটতি “ইচ্ছা” করেন না; বরং কারণ–কার্য শৃঙ্খল এমন ফল বয়ে আনে।

প্রশ্ন হলো—অন্যের ভুলের কারণে এক শিশুর কষ্টভোগ কি যুক্তিসঙ্গত?
উত্তর—কারণ–কার্য সম্পর্ক ছাড়া দুনিয়া চলতেই পারে না। যদি প্রতিটি ফলকে আল্লাহ অকস্মাৎ পরিবর্তন করে দিতেন, তবে মানুষ কখনোই কোনো কাজের ফল নির্ধারণ করতে পারত না, বিজ্ঞান–অগ্রগতি অর্থহীন হয়ে যেত। যেমন অ্যান্টিবায়োটিক রোগ সারায়, কিন্তু একই ওষুধ গর্ভাবস্থায় ক্ষতি করতে পারে; মাধ্যাকর্ষণ মানুষকে নিরাপদে চলতে সাহায্য করে, আবার উঁচু থেকে পড়লে মৃত্যুরও কারণ হয়।

শিশুর শারীরিক ত্রুটি প্রায়ই এই জগতের অবশ্যম্ভাবী কাঠামোর অংশ—মানুষ একে অন্যের আচরণ, সিদ্ধান্ত ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেউ পিতামাতার সম্পদ, বংশগৌরব বা জিনগত শক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পায়; আবার কেউ জৈবিক দুর্বলতা নিয়ে জন্মায়—এটাই বাস্তব জগতের নিয়ম।

কিন্তু আল্লাহর ন্যায় সেখানে নিশ্চিত হয়, যেখানে মানুষের কষ্ট, সীমাবদ্ধতা ও ভিন্নতা অনুযায়ী তার দায়িত্ব, কর্তব্য ও পরকালীন প্রতিদান নির্ধারিত হয়।
হাদিসে এসেছে—দুনিয়ায় যারা অধিক কষ্ট সহ্য করে, তারা আখেরাতে এমন পুরস্কার পাবে যে কষ্টহীন জীবন যাপনকারীরা আফসোস করবে যে, যদি তাদের দেহ মাংস কেটে নেওয়া হতো তাহলেও এ পুরস্কার তারা পেত না।

অতএব, শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের দায়িত্ব ও জবাবদিহি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো অবিচার করেন না। দুনিয়ার বৈষম্যগুলো পরকালে নিপুণ ন্যায়ে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়।

পাদটীকা

১. সৈয়দ মোহসেন খরাজি, আল-বিদায়া আল-মা‘আরিফ আল-ইলাহিয়্যাহ ফি শারহ আকায়িদ আল-ইমামিয়্যাহ, ইসলামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, ক্বোম, ১৪১৭ হিজরি ক্বমরী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৯৭।  অনুবাদ: সৈয়দ মোহসেন খরাজির “আল্লাহর জ্ঞানের সূচনা: ইমামিয়া আকীদার ব্যাখ্যা”, ইসলামি প্রকাশনা সংস্থা, ক্বোম, ১৪১৭ হিজরি ক্বমরী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৭।

২. শাইখ হাসান দাইলামি, ইরশাদ আল-কুলুব ইলা আল-সাওয়াব, শরীফ রাযি, ক্বোম, ১৪১২ হিজরি ক্বমরী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪২।  অনুবাদ: শাইখ হাসান দাইলামির “হৃদয়কে সত্যের পথে দিশা”, শরীফ রাযি প্রকাশনা, ক্বোম, ১৪১২ হিজরি ক্বমরী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪২।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button